ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল অবকাঠামোর নির্মাণ শুরু হয়েছে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। তবে প্রকল্পের কাজে এখনও পুরোপুরি গতি আসেনি। ফলে গত তিন অর্থবছরের মতো এবারও প্রকল্পটির বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে না। এজন্য পদ্মা সেতুর বরাদ্দ ৯২৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা কমানোর প্রস্তাব করেছে সেতু বিভাগ। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, চলতি অর্থবছর এডিপিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ছয় হাজার ২৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর নভেম্বর পর্যন্ত ছাড় করা হয়েছে এক হাজার ৫০৪ কোটি ১২ লাখ। তবে প্রকল্পটিতে ব্যয় করা হয়েছে আরও কম, ৯৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ মাসে বরাদ্দের মাত্র ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। ফলে পুরো বছরে বিশাল এ বরাদ্দের বড় অংশই অব্যবহƒত থেকে যাবে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছর সংশোধিত এডিপিতে পদ্মা সেতুর বরাদ্দ কমিয়ে পাঁচ হাজার ৯৯ কোটি ১০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর বরাদ্দ কমছে ১৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা ৯২৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, বর্ষার কারণে অর্থবছরের শুরুর কয়েক মাসে গতি থাকে না। এখন মূল অবকাঠামোর কাজে গতি এসেছে। যদিও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কাজ কিছুটা পিছিয়ে আছে। এজন্য বরাদ্দ কিছুটা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত অর্থবছর শুরুতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সাত হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে ব্যয় না হওয়ায় অর্থবছর শেষে তা কমিয়ে তিন হাজার ৫৯২ কোটি টাকা করা হয়। একইভাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আট হাজার ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ থাকলেও পরে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়। একইভাবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। তবে তা কমিয়ে দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা করা হয়।
সেতু বিভাগের তথ্যমতে, ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর ৩৩ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। মূল সেতুর ২৭টি পাইলের তলদেশের ৭০ মিটার এবং ৯টি পাইলের সম্পূর্ণ ১২৮ মিটার ড্রাইভ সম্পন্ন হয়েছে। ট্রায়াল পাইল ৫ ও ৬-এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অতিরিক্ত ট্রায়ার পাইল ৭-এর কাজ চলমান রয়েছে। পাইল নির্মাণের জন্য ১৭ হাজার স্টিল পাইল ফেব্রিকেশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এক লাখ ২৯ হাজার টন স্টিল প্লেটের মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার টন প্রকল্প এলাকায় এসে পৌঁছেছে। চীন ও বাংলাদেশে সুপার স্ট্রাকচারের থ্রিডি অ্যাসেম্বলিংয়ের কাজ চলছে। মাওয়ার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ১৫০ মিটার তিনটি ট্রান ফেব্রিকেশনের কাজ চলমান আছে। মূল সেতুর আটটির টেস্ট পাইলের মধ্যে পাঁচটি ও ভায়াডাক্টোর সব টেস্ট পাইলের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি মূল সেতু নির্মাণে অ্যালাইমেন্ট বরাবর ১৫০ মিটার প্রশস্ত চ্যানেল তৈরিতে নদীতে ড্রেজিং চলছে। আর জাজিরা ভায়াডাক্টের ২৬টি বোর্ড পাইলের কাজ চলমান আছে।
নদী শাসনের অগ্রগতি আরও কম। ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অংশের ২৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন সাইজের বোল্ডার, স্টোনচিপস, সিলেট বালি, সিমেন্ট ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহের কাজ চলছে। এক কোটি ৩৩ লাখ কংক্রিট ব্লকের মধ্যে ৩৩ লাখ নির্মাণ করা হয়েছে। আর দুই কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার বালি ভর্তি জিও ব্যাগের মধ্যে ১১ লাখ নদীর দুই পাড়ে ফেলা হয়েছে। জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে এক হাজার ১০০ মিটার অ্যাপ্রোন ও ৮০০ কেজি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়েছে। মাওয়া প্রান্তে গত বর্ষা মৌসুমে সৃষ্ট সাত লাখ ঘনমিটারের দুটি গর্ত ভরা হয়েছে।
সংযোগ সড়ক দুটির কাজ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত জাজিরা সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ ৮৪ ও মাওয়া সংযোগ সড়ক শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। আর সার্ভিস এলাকা নির্মাণের কাজও শতভাগ শেষ হয়েছে। তবে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। তিন হাজার ৬৩৫ একর জমির মধ্যে দুই হাজার ৭৩৬ একর অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বাকি অংশ এখনও অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলছে। আর নামজারি করা হয়েছে মাত্র ৮৬৩ একর জমির। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও এখনও শেষ হয়নি। পাশাপাশি পরিবেশ কার্যক্রম বিশেষত বৃক্ষ রোপণও বাকি রয়েছে।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্ট দলের সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, যে কোনো প্রকল্পের শুরুর দিকেই কাজে গতি কিছুটা কম থাকে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও এটি হয়েছে। তবে এ প্রকল্পে আরও কিছু জটিলতা রয়েছে। যেমন পূর্ণ বর্ষায় তীব্র স্রোতে নদীতে কাজ করা কঠিন। আবার ইলিশের প্রজনন মৌসুমে নদীতে পাইলিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাতে মাছের বিচরণ ও ডিম পাড়া ব্যাহত না হয়। এজন্য পদ্মা সেতুর কাজে গতি কিছুটা কম। তবে নদীর নিচের কাজ শেষ হলে বাকি কাজ দ্রুত শেষ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে আগামী বছর এ প্রকল্পে পূর্ণ গতিতে চলবে আশা করা যায়।
Add Comment