মেহেদী হাসান: দেশের অর্থনীতিতে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বাড়লেও পিছিয়ে পড়েনি কৃষি খাত। কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়। তবে অধিকাংশ ব্যাংকের আগ্রহ কম কৃষিঋণ বিতরণে। চলতি অর্থবছরের চার মাস শেষে কৃষিঋণ বিতরণে পিছিয়ে রয়েছে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি মিলে ১৪টি ব্যাংক। এর মধ্যে কয়েকটি বিদেশি ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো কৃষিঋণ বিতরণ করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায় ছয় হাজার ২০৫ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে, যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দুই হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা; বেসরকারি ব্যাংকগুলো তিন হাজার ৭০৪ কোটি টাকা ও বিদেশি ব্যাংকগুলো ১১৭ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যতই বলুক তফসিলি ব্যাংকগুলো আগের গতানুগতিক মানসিকতায় রয়ে গেছে। তাই কৃষিঋণ বিতরণে তারা আগ্রহ দেখায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকগুলো বড় ঋণ দেওয়ার জন্য আগ্রহী, কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে তাদের আগ্রহ কম। অর্থশালী গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে সক্ষমতা গড়ে তুলতেই ব্যাংকগুলো ব্যস্ত। তাই কৃষিঋণের লক্ষ্য পূরণে ব্যাংকগুলো পিছিয়ে পড়ছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের চার মাস অতিবাহিত হলেও কৃষিঋণ বিতরণে পিছিয়ে রয়েছে ১৪টি ব্যাংক। লক্ষ্যমাত্রার দিক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে রূপালী ব্যাংক লিমিটেড। পুরো অর্থবছরের জন্য ব্যাংকটির ২০০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩ কোটি টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকটি, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ছয় দশমিক ৭৮ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা আট দশমিক ৭০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করেছে বিডিবিএল। পুরো অর্থবছরের জন্য ৫০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ব্যাংকটি বিতরণ করেছে মাত্র চার কোটি টাকা।
এদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ফারমার্স ব্যাংক। পুরো অর্থবছরের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বিতরণ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চার মাসে ব্যাংকটি মাত্র এক কোটি টাকা বিতরণ করেছে। ইউনিয়ন ব্যাংক করেছে চার দশমিক ৭৯ শতাংশ। চার মাসে ব্যাংকটি মাত্র ১৩ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। প্রিমিয়ার ব্যাংক সাত কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার তিন দশমিক ২৪ শতাংশ। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক বিতরণ করেছে মাত্র এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার এক দশমিক ১৯ শতাংশ। মধুমতী ও মেঘনা ব্যাংক পাঁচ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার সাত দশমিক ৪৬ শতাংশ। এবি ব্যাংক ৩০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। চার মাসে যা লক্ষ্যমাত্রার সাত দশমিক ৬৬ শতাংশ।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্যাংক আল ফালাহ, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং ওয়ারি ব্যাংক অর্থবছরের চার মাসে কোনো কৃষিঋণ বিতরণ করেনি। তবে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র চার শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের চার মাসে সবচেয়ে বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করেছে বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকটি প্রায় এক হাজার ৪৬৪ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৩০ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের চার মাসে ব্যাংকটি কৃষিঋণ হিসেবে ৪৪২ কোটি টাকা বিতরণ করেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করলেও সে সময় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক ও বিডিবিএল কৃষিঋণ বিতরণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। অগ্রণী ব্যাংক ৬৩১ কোটি টাকা বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৬ শতাংশ। বিডিবিএল মাত্র পাঁচ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। এ ব্যাংকের বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ কোটি। অন্যদিকে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক, মধুমতী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। বিদেশি মালিকানার ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান কৃষি খাতে কোনো ঋণ বিতরণ করেনি।