ঘোষণা ছাড়া স্বর্ণ মজুত করলে বাজেয়াপ্তের সুপারিশ

জাকারিয়া পলাশ: স্বর্ণ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ শিল্পের সম্ভাবনা দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার মজুত রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তবে মজুতের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। নির্ধারিত পরিসীমার চেয়ে বেশি স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মজুত থাকলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রস্তাবিত স্বর্ণ খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি-বিষয়ক খসড়া নীতিমালায় এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া স্বর্ণনীতি বাস্তবায়ন ও পরীবিক্ষণের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব করা হয়।

মাফিয়ানির্ভর স্বর্ণ খাতে সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর আইনি ব্যবস্থার কথা আলোচনায় এসেছে বিভিন্ন সময়। এর আগে চোরাচালানির ওপর নির্ভর করেই চলছিল দেশে স্বর্ণসংশ্লিষ্ট শিল্প খাত। ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অভিযোগ করে আসছিলেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় স্বর্ণ আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশের অভ্যন্তরে স্বর্ণালংকার তৈরি ও তা বিদেশে রফতানির সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নীতিগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারি পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে সম্প্রতি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ খাতের ওপর একটি গবেষণা করে বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি) কার্যকর নীতি প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে। এ বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালাও প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। অর্থমন্ত্রীর কাছে সম্প্রতি এ নীতিমালা দেওয়া হয়েছে।

খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, সংশ্লিষ্টদের ধারণা অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে স্বর্ণের প্রকৃত চাহিদার পরিমাণ বার্ষিক ২০ থেকে ৪০ টন। এর মধ্যে আনুমানিক ১০ শতাংশ তেজাবি স্বর্ণের (রিসাইক্লিং) মাধ্যমে সংগৃহীত হয়। সে হিসাবে দেশে বার্ষিক নতুন স্বর্ণের চাহিদা প্রায় ১৮ থেকে ৩৬ টন। স্বর্ণশিল্পের কাঁচামালের এ বিপুল প্রয়োজন মেটাতে কোনো বৈধ স্বর্ণ আমদানির ব্যবস্থা কার্যকর নেই। চোরাপথে ও ব্যাগেজ রুলের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে এ স্বর্ণ আমদানি হচ্ছে। এছাড়া স্বর্ণালংকারের দোকানে চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ঘটনায় বাংলাদেশের স্বর্ণালংকার শিল্পও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সার্বিকভাবে অর্থ পাচার, মানব পাচার, মাদকদ্রব্য ও অবৈধ অস্ত্র পাচারের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বিনিময় হিসেবে স্বর্ণের (মুদ্রা) ব্যবহার হওয়ার কারণে অপরাধ বৃদ্ধি ঝুঁকি বাড়ছে। এর ফলে সুশাসন ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অধিকতর চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ‘এ বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি টিআইবিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে টিআইবি এ নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। বিভিন্ন অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে আলোচনার মাধ্যমে এ নীতিমালাটি প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজনের পর চূড়ান্ত করা হবে বলে আমরা আশা করি। একই সঙ্গে আমরা যেকোনো নীতিমালা বা আইনি কাঠামো প্রণয়নের পাশাপাশি এর কার্যকর বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। নীতিমালা করে তার বাস্তবায়ন না হলে সেটি কোনো খাতেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারবে না।’

প্রস্তাবিত ও খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যবসায়ীর সর্বশেষ বছরের বিক্রীত স্বর্ণের বিপরীতে মূসক চালানে যে পরিমাণ উল্লেখ করা হয়, সে অনুযায়ী তার মজুতের সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মজুত করার বৈধতা দেওয়া হবে। এ পরিসীমার অতিরিক্ত স্বর্ণ বা স্বর্ণালংকারের মজুত বাজেয়াপ্ত করা হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে দেশে একটি কেন্দ্রীয় স্বর্ণ ওয়্যারহাউজ প্রতিষ্ঠ করা যেতে পারে। নিয়মিতভাবে ওই ওয়্যারহাউজ থেকে খোলাবাজারে বৈধ ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছে স্বর্ণ বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে।

নীতিমালায় স্বর্ণ আমদানিতে পর্যায়ক্রমে শুল্ক হ্রাস ও আমদানি অবাধকরণ, নির্ধারিত সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানির ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি স্বর্ণের মান নির্ণয়ের জন্য হলমার্ক চিহ্নের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়। এছাড়া যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালার কার্যকর প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়। সূত্রমতে, যাত্রী ব্যাগে আমদানি বিধিমালা-২০১৬ অনুযায়ী ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণপিণ্ড বা বার দেশে আনার সুযোগ রয়েছে যাত্রীদের। এজন্য তাদের প্রতি ১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম (ভরি) সোনায় তিন হাজার টাকা শুল্ক দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এছাড়া একজন যাত্রীকে সর্বাধিক ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালংকার শুল্কমুক্তভাবে আমদানির সুযোগ রয়েছে। টিআইবির খসড়া নীতিমালায় এ ব্যবস্থার সংস্কার প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, বিনা শুল্কে যাত্রীপ্রতি বার্ষিক সর্বাধিক দুবার সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম অলংকার এবং নিবন্ধিত স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যাগেজ রুলের অধীনে শুল্কসহ সর্বোচ্চ দুই কেজি পর্যন্ত স্বর্ণবার আনার সুযোগ দেওয়া হবে।

এছাড়া প্রস্তাবে স্বর্ণালংকার রফতানিতে প্রণোদনা সৃষ্টি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের জন্য রফতানি সনদ, রেয়াত ও ভর্তুকি, অবচয় সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি সুপারভাইজড বন্ডেড ওয়্যারহাউজ পদ্ধতি বিলুপ্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে উচ্চ সুদের (বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ) বন্ধকি ব্যবসাকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনার কথা বলা হয়।

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০