নিজস্ব প্রতিবেদক : উন্নয়নের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাংলাদেশের সামনে বড় কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বৈষম্যহীনভাবে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কাউকে পিছিয়ে রাখার সুযোগ নেই। সবাইকে নিয়েই উন্নয়নের পথে যেতে হবে। এজন্য বেসরকারি সংস্থাকে মুখ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারি সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীসহ সব স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সমন্বয় এবং জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ‘বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়ন কাউকে পেছনে রাখা যাবে না’ শীর্ষক নাগরিক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেছেন।
গতকাল বুধবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এ নাগরিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সভাপতি অধ্যাপক রেহমান সোবহান। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় দিনব্যাপী এ সম্মেলনের প্রারম্ভিক অধিবেশনে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অন্যদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম প্রমুখ। সম্মেলনে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে সক্রিয় এনজিও, ব্যবসায় উদ্যোক্তা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিতি ছিলেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
সভাপতির বক্তব্যে সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, এসডিজি অর্জনে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর চাহিদার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিদেশি উন্নয়ন সহযোগিতাগুলোর মধ্যে সমন্বয় রাখতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘দেশে যেন সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, মানুষ যাতে তার অধিকার ভোগ করতে পারে, সেটা অবশ্যই নজরে রাখতে হবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সুষম বণ্টনের একটি সম্পর্ক থেকে যায়। বিভিন্ন খাতে মানুষ এত উন্নতি করার পরও অনেক মানুষ এখনও বৈষম্যের শিকার। পৃথিবীর বেশিরভাগ সম্পদ কিছু মানুষের হাতে। তাই বলা যাবে না মানুষের সামগ্রিক উন্নতি হয়েছে। মানুষ যেন নিজেদের মর্যাদা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দেশ বিস্ময়কর অগ্রগতি লাভ করেছে। কিন্তু এর পাশাপাশি মানুষের ব্যর্থতাও কম নয়। ছোট থেকেই জানি পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। কিন্তু সুপেয় পানি পায় না এ রূপ মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।’
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশ্ব এখন অনেক এগিয়েছে, কিন্তু প্রতিদিন ন্যূনতম চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বহু মানুষ। আমরা দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা দেখে মুগ্ধ হই, কিন্তু ভুলে যাই বহু মানুষ এখনও খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে, রাত কাটায়। তার মতে, মানুষের সাফল্য যেমন অনেক, ব্যর্থতাও কিছু নয়। মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা বেড়েছে, তার প্রমাণ রোহিঙ্গা বিতাড়ন।
সেলিনা হায়াৎ আইভি বলেন, নাগরিক সমাজকে যুক্ত না করে উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদেরও এখানে যুক্ত রাখতে হবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাই মূলত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করে। সুতরাং স্থানীয় সরকারকে প্রাধান্য দিতে হবে।
দিনব্যাপী সম্মেলনে এসডিজির ১৭টি অভীষ্ট ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে এসডিজির অর্থনৈতিক, সামাজিক, জলবায়ু ও পরিবেশ এবং সুশাসন প্রসঙ্গ নিয়ে আলাদা আলাদা অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া সমাপনী অধিবেশনে রাজনীতিবিদ ও নাগরিক প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন। বিভিন্ন সেশনে জ্ঞান তাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. আহরার হোসেন, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিমিন মাহমুদ, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, অ্যাকশনএইডের বাংলাদেশ প্রধান ফারাহ কবির, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামানসহ শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করেন।
অর্থনৈতিক প্রসঙ্গে বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজি বাস্তবায়নে ৯২৮ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হবে। এর জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বড় ভূমিকা নিতে হবে।
ব্র্যাকের কর্মকর্তা আজাদ রহমান বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধা নণ্টন যথাযথভাবে হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত প্রাপকরা সুবিধা পাচ্ছেন না। সরকার ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিত করেই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেওয়া দরকার।
শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্থা বিলসের প্রধান বলেন, সরকারের নীতিতে বড় সংস্কার জরুরি। সরকার ৯০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বেতন নির্ধারণ করে দিচ্ছে না। যেসব খাতে সরকারি নির্ধারিত বেতন কাঠামো আছে সেখানেও চার হাজার টাকাও বেতন রয়েছে। এই বেতনের মাধ্যমে কারও জীবনমান উন্নত করা সম্ভব নয়।
সিডিপির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশেষভাবে পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য সরকারের নীতি আছে; যেমন নারীনীতি, শিশুনীতি, যুবনীতি। কিন্তু এসব নীতির সঙ্গে মূলধারার নীতিগুলোর সমন্বয় নেই। বিদ্যুৎ, গ্যাস, সড়ক, রেল, পানি ব্যবস্থাপনা, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়াদের সুযোগ নিশ্চিত হচ্ছে না। এজন্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সহায়ক করে এসব সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাপ্যতা, অভিগম্যতা ও কেনার সামর্থ্য নিশ্চিত করতে হবে।