বিশ্ব ঐতিহ্যে আমাদের শীতলপাটি

শীতলপাটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যময় কুটিরশিল্প। শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, এ শিল্প এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশের শীতলপাটি। গত ৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ইউনেসকোর ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের ১২তম অধিবেশনে ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটিকে বিশ্বের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন শীতলপাটি। এক ধরনের মুর্তা গাছের বেতি থেকে বিশেষ বুননকৌশলে শিল্পরূপ ধারণ করে শীতলপাটি। নদীনালা, খালবিল, পুকুরপাড়, ডোবা ও জলাভূমিতে জন্ম মুর্তা। অনেক সময় ধানের জমিসহ ডোবা বা কর্দমাক্ত জমিতেও এ গাছের চাষ করা হয়।

মুর্তা বা পাটিপাতা কেটে এনে বেতি বের করে তা শুকিয়ে এবং পরে ভিজিয়ে শীতলপাটি তৈরির উপযোগী করা হয়। পাটি তৈরির জন্য মুর্তার ছাল বের করা হয়। একটি ছাল পাটি তৈরির জন্য প্রস্তুত করে তুলতে আলাদাভাবে সাতবার হাতে নিতে হয়। প্রথম দফায় মুর্তা থেকে চার ভাগ করে বেত বের করা হয়। এরপর সরু করতে হয়। তুলে ফেলতে হয় সম্পূর্ণ আঁশ। তারপর বেতি আকারে সমান করতে হয়। আবার ছাল ফেলে রোদে শুকানো হয়। এরপর বেতিগুলো আরও এক ঘণ্টা পানিভর্তি টিনের পাত্রে ভিজিয়ে, গরম পানিতে সেদ্ধ করা হয়। সেদ্ধ শেষে বেতিগুলো রোদে শুকিয়ে আবার ঠাণ্ডা পরিষ্কার পানিতে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট ভিজিয়ে ধুয়ে তোলা হয়। এভাবে মুর্তা বেতি পাটি তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহারযোগ্য হয়। অনেক সময় পাটিতে নানা রং দিতে হয় কারুকাজের জন্য।

সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, বরিশাল, ঝালকাঠি, ঢাকা, ফরিদপুর, কক্সবাজার,

লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালী প্রভৃতি জেলার নানা জায়গায় এ গাছ পাওয়া গেলেও শীতলপাটি বুননশিল্পীদের বেশিরভাগই বৃহত্তর সিলেটের বালাগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার নিচু এলাকায় বসবাস করেন। বুননশিল্পীরা বংশপরম্পরায় পাটি বুনন কৌশল আয়ত্ত করেছেন। সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটির ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। জাতীয় জাদুঘর এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, সিলেটের ১০০ গ্রামের প্রায় চার হাজার পরিবার সরাসরি এই কারুশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই বুননশিল্পীরা ‘পাটিয়াল’ বা ‘পাটিকর’ নামে পরিচিত। তারা জানান,নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পাটি বোনার কাজ করেন। তবে নারীরা কাজে তুলনামূলকবেশি ভূমিকা রাখেন।

পৌরাণিক কাহিনী, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, শাপলা, পাখি, ফুল-লতা-পাতা, জ্যামিতিক নকশা, মসজিদ, চাঁদ, তারা, পদ্ম, প্রিয়জনের নাম, কবিতা প্রভৃতি ফুটিয়ে তোলা হয় শীতলপাটির ওপর।

শীতলপাটির কদর ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। শীতলপাটিতে শুলে খুব গরমেও ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ার একটা বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। এজন্য গরমকালে সিলেট অঞ্চলের বাড়িঘরে বিছানার চাদরের ওপর এর ব্যবহার দেখা যায়। বিশেষ বুনন প্রক্রিয়ার কারণেই পাটিতে শীতলতা থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি মোগল শাসনামলে সম্রাট আওরঙ্গজেব ও ব্রিটিশ আমলে রানি ভিক্টোরিয়ার রাজদরবারে উপঢৌকন হিসেবে গিয়েছিল। রাজরাজারা যারপরনাই প্রীত হয়েছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯১৯ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমন্ত্রিত হয়ে সিলেটের বেত ও বাঁশের বানানো চেয়ার-টেবিল, ব্যাগ প্রভৃতি দেখে অভিভূত হয়ে তা কিনে শান্তিনিকেতনে ব্যবহার করেছিলেন।

উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের বাউল গান, ২০১৩ সালে জামদানি বয়নশিল্প ও ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেসকোর নির্বস্তুক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো।

 

আজহার উদ্দিন শিমুল

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০