আর্থিক খাতে ভরসার অভাব তৈরি হয়েছে: ড. আতিউর রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক : টাকার অভাব বড় অভাব নয়, অভাব ভরসার। আর্থিক ব্যবস্থাপনাটাই চলে বিশ্বাসের ওপর, নৈতিকতার ওপর। এ ব্যবস্থাপনায় যদি নৈতিকতা না থাকে, সেটা অর্থপূর্ণ হতে পারে না। আর বর্তমান সময়ে আর্থিক খাতে ভরসার অভাব তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এ কথা বলেছেন।

গতকাল রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে (আইডিইবি) বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ‘আর্থিক খাতে ভরসার অভাব: বিশেষ প্রায়োগিক ক্ষেত্রসমূহ’ সেশনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আটটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা অংশ নেন।

ড. আতিউর বলেন, আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যাংকগুলোর মূল দায়িত্ব। কারণ ব্যাংকে মূল অর্থায়ন তারাই করে থাকে। ব্যাংকে উদ্যোক্তাদের অর্থ থাকে মাত্র ১০ শতাংশ। তাই গ্রাহকদের ৯০ শতাংশ অর্থ দিয়ে তারা ব্যবসা করে যাবে আর ঋণগ্রহিতা ও আমানতকারীদের ঠকাবে, এটা হতে পারে না। তাই এগুলো দেখভাল করাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে যারা হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে, তারা কি সিএসআর (সামাজিক দায়বদ্ধতা) পালন করছে। আমরা শুধু ব্যাংকের ওপর চাপ দিই। এখন সময় এসেছে যারা কোটি টাকা ঋণ নেয় তারা সিএসআর পালন করে কি না, তা দেখার।

এদিকে নীতিনির্ধারকদের আত্মতুষ্টি আর বাস্তবায়নকারীদের গাফিলতি সমাজ ও অর্থনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি বলেন, নীতিনির্ধারকদের বলা হয় সবকিছু ভালো চলছে। অনেক কাজ করা হয়েছে। আর কিছু করা দরকার নেই। এ কথা শুনে তারা আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। আর যারা বাস্তবায়নকারী তারা কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার পর গাফিলতি শুরু করেন। এ আত্মতুষ্টি ও গাফিলতি সমাজে, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সর্বত্র বিদ্যমান।

সুনামগঞ্জে হাওরে আগাম বন্যার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছরই হাওরে বন্যা হয় এবং বাঁধ ভাঙে। এবার একটু আগাম হয়েছে। যে বাঁধ দেওয়া হয় সেটা প্রতিবছর বন্যার সময় পানি নিচে ডুবে যায় এবং ভেঙে যায়। কিন্তু তার আগেই ফসল কাটা হয়। বাঁধ নির্মাণের জন্য বন্যাকালীন সময়ের এক মাস আগে কমিটি করা হয়। এবার সেটি করা হয়নি। এটাই নৈতিকতার স্খলন। যার কমিটি করার কথা তিনি কমিটি করেননি, অর্থাৎ গাফিলতি করেছেন। আর ওপরে যারা আছেন তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনো সমস্যা নেই। সুতরাং তারা আত্মতুষ্টি নিয়ে আছেন। এ আত্মতুষ্টি ও গালিফলি সমাজ-অর্থনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ‘শিল্পসংক্রান্ত বিষয়াবলি’ শীর্ষক সেশনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, দেশে নীতির কোনো অভাব নেই। অনেক ক্ষেত্রে খুব ভালো আইনও আছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে না আত্মতুষ্টি আর গাফিলতির কারণে। এগুলো সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর দেখা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশ দেন তার সবগুলোই ভালো। কিন্তু এগুলো যারা বাস্তবায়ন করবেন তারাই কাজ করেন না। আরেকটি বড় সমস্যা বাস্তবায়ন। খুব বড়-ভালো বাজেট করা হয়। প্রথম চার মাসে ১০ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন হয়। অথচ শেষ এক-দুই মাসে সব বাস্তবায়ন হয়ে যায়। প্রথম দিকে কাজ না হওয়া যেমন সমস্যা তেমনি শেষ দিকে বেশি বাস্তবায়ন হওয়া আরও বড় সমস্যা। কাজ না হলেও সব টাকা চলে যায়। এক্ষেত্রে যারা বাজেট বাস্তবায়ন করেন তাদের চরিত্র ঠিক করা উচিত।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) প্রসঙ্গে বলেন, এসডিজি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা, সেমিনারে আলোচনায় অর্থনীতিবিদ-মন্ত্রীরা বলেন, এটা করতে হবে-ওটা করতে হবে। এসব তো এসডিজিতে বলাই আছে। মন্ত্রী-অর্থনীতিবিদদের বলা উচিত, এটা করেছি-ওটা করেছি। আর অর্থনীতিবিদদের বলা উচিত, লক্ষ্য অর্জনে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে।

এর আগে দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সকালে চারটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো বিষয়বস্তু ছিল ‘ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত’, ‘বিশেষ প্রায়োগিক ক্ষেত্রসমূহ’, ‘দারিদ্র্য ও অসমতার সমস্যাসমূহ’ এবং ‘মানব মূলধন সংক্রান্ত’।

‘বাংলাদেশের সংবিধান ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ: কিছু নৈতিক প্রশ্ন’ প্রবন্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন খান বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারকে দিনবদলের সনদ আখ্যা দিয়েছিল। দিনবদল পুরোপুরি যেতে অনেক দূর যেতে হবে। টেকসইভাবে দারিদ্র্য উচ্ছেদ, একমুখী শিক্ষা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, দুর্নীতি রোধ, দখল-জবরদখলের মতো বিষয়গুলো সুরাহা হয়নি। আমলাতন্ত্রের সমস্যা তো আছেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা অবশ্যই আমলাতন্ত্র। সরকার আমলাতন্ত্রকে দায়িত্বশীল করার পরিবর্তে দায়মুক্তি ও আরও ক্ষমতাবান করতেই বেশি আগ্রহী।

এ অধ্যাপক আরও বলেন, বর্তমান সরকার দাবি করছে তারা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেছে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটি উচ্চারণ করতে লজ্জাবোধ করেন। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের কথা উচ্চারণ করেন কালেভদ্রে। আর সমাজতন্ত্রকে পাঠিয়েছেন নির্বাসনে।

‘শিক্ষাব্যবস্থায় করপোরেট সংস্কৃতি: টেকসই উন্নয়নে এ যেন এক অশনিসংকেত’ শীর্ষক প্রবন্ধে সিলেট ক্যাডেট কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ জসীম উদ্্দীন বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় এখন করপোরেট সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষার সব স্তরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান করপোরেট আদলে পরিচালিত হচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। আর কতিপয় মুনাফালোভী ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিকে লাভের পথ সুগম করে দিচ্ছে রাষ্ট্র কাঠামো। সরকার দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে সুবিধা করে দিতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

জসীম উদ্দীন বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় ঢাকা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত মুনাফালোভী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে। কেউ দেখছে না। কেউ কিছু বলছে না। শিক্ষাক্ষেত্রে এ সংস্কৃতি পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত সেশনে ‘অর্থনীতি ও নৈতিকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর উপস্থাপনের কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তবে তার লিখিত প্রবন্ধে বলা হয়, দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতার হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। যার ফলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সরকারগুলো আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না। তারা স্বৈরচারী আদলে দেশ চালাচ্ছে। এতে করে মানুষ শঙ্কিত ও সংশয়ে আছে। কারণ বারবার সরকার বদল করেও তাদের দুর্ভোগ কমছে না বরং বাড়ছে। এ ব্যবসায়ীর মতে, দেশে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ হলো সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে মিন্টু বলেন, উভয় দলে রয়েছে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় রাজনৈতিক অপরাধীদের চক্র। আর এ অপরাধচক্রের বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। অনৈতিক রাজনীতিই দুর্নীতির মূল উৎস।

দারিদ্র্য ও অসমতার সমস্যাসমূহ সেশনের সভাপতির বক্তব্যে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিনিয়ত মানুষের প্রয়োজন পরিবর্তন হচ্ছে। ১৯৭০ সালে শিক্ষা মূল প্রয়োজনের মধ্যে ছিল না। কিন্তু এখন সবাই শিক্ষাগ্রহণ করছে। তেমনি ২০৩০ সালে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়তে হলে দারিদ্র্যের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষুধামুক্ত বলতে কি শুধু পেট ভরে খাওয়াকে বোঝানো হবে নাকি পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ খাবার থাকবে। তিনি আরও বলেন, মাথাপিছু আয় বাড়ানোর চেয়ে সম্পদের বণ্টন বাড়াতে হবে।

আজ সম্মেলনের সমাপনী দিনে ছয়টি সেশন অনুষ্ঠিত হবে। এগুলো অংশ নেবেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও পেশাজীবীরা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০