লালমনিরহাট সদর উপজেলার নারী উদ্যোক্তা উত্তমা রায়। পেশায় গৃহিণী হলেও নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন সমন্বিত খামার। তার খামারে রয়েছে দেশি-বিদেশি কবুতর, মুরগি, গবাদিপশু ও মাছ। এখানে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেক হতদরিদ্র নারী। নারী উন্নয়নে ভূমিকা রাখা এই উদ্যোক্তার সঙ্গে আলাপচারিতায় শেয়ার বিজের লালমনিরহাট প্রতিনিধি জাহেদুল ইসলাম সমাপ্ত
শেয়ার বিজ: খামার তৈরির শুরুটা জানতে চাই…
উত্তমা রায়: কোনোদিন খামার করবো এমন চিন্তা আমার ছিল না। একদিন সপরিবারে এক জায়গায় বেড়াতে যাই। সেখানে একটি পোলট্রি খামার দেখে খুব ভালো লাগে। ইচ্ছা জাগে এমন একটি পোলট্রি খামার করার। বাড়িতে এসে জায়গা নির্বাচন করে ১০৮টি মুরগির বাচ্চা দিয়ে ছোট আকারে একটি খামার তৈরি করি। দেখভাল আমিই করতাম। মুরগির সংখ্যা এক হাজারে দাঁড়ালে কর্মী নিয়োগ দিই। বর্তমানে এক একর জমির ওপর এই পোলট্রি খামারে ছয় হাজার মুরগি আছে। এখানে ১১ নারী ও দুই পুরুষ কাজ করছেন। এই তো আমার খামার শুরুর গল্প।
শেয়ার বিজ: আর অন্য খামারগুলো…
উত্তমা রায়: আবারও বেড়ানোর গল্প। এবারও সপরিবারে সৈয়দপুরে ননদের বাসায় বেড়াতে যাই। তখন আমার সন্তানরা ছোট। ওদের জন্য পাশের এক বাড়িতে দুধ কিনে আনতে যাই। দেখতে পাই, এক মহিলার দুটি গাভী রয়েছে। আশপাশের সবাই তার কাছ থেকেই দুধ কিনে নিয়ে যায়। তখন বুঝতে পারি, পোলট্রি খামারের পাশাপাশি গাভীপালন বেশ লাভজনক। আমি কাজটি ভালমতো করতে পারব। লালমনিরহাটে এসে একটি গাভী কিনে পালন শুরু করি। আমার এখানে বর্তমানে ৩৩টি গাভী ও ২৭টি বাছুর আছে। কবুতর পালনের গল্পও প্রায় একই। এক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে কবুতর পালতে দেখে মনে ইচ্ছা জাগে কবুতর পালনের। প্রথমে এক জোড়া কবুতর পালতে শুরু করি। এখন ১৮ জাতের কবুতরের একটি খামার তৈরি করেছি। তবে শখের বসে কবুতর পালন চালু করলেও এখন একে বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছি। এছাড়া এক একর জমির ওপর পুকুর করে মাছ চাষও হচ্ছে এখানে।
শেয়ার বিজ: অন্য কোনো ব্যবসা বা চাকরিতে নিজেকে জড়াতে পারতেন, তা না করে এ ব্যবসায় এলেন কেন?
উত্তমা রায়: আশা ছিল কিছু একটা করবো। কিন্তু কী করবো সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তবে চাকরি করতে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে তা আমার নেই। আমি ১৯৮৬ সালে এসএসসি পাস করেছি, এরপর আর পড়ালেখা করিনি। তাই চাকরির বিষয়টি মাথায় ছিল না। এছাড়া সন্তানদের দেখাশোনা ও সংসার সামলানোর দায়িত্ব তো আছেই। খামারের ব্যবসা শুরু করার পর বুঝতে পারছি, বাসায় থেকে খামার পরিচালনার পাশাপাশি সন্তানদের দেখাশোনা ও সংসারের যাবতীয় কাজ করা বেশ সুবিধাজনক।
শেয়ার বিজ: উদ্যোক্তা হতে গিয়ে কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?
উত্তমা রায়: খামারটি চালুর প্রথম দিকে পরিবার থেকে কিছুটা বাধা ছিল। এজন্য কিছুটা সমস্যায় পড়ি। তবে আমার স্বামী পাশে থাকায় পরিবারের সমস্যাগুলো অতিক্রম করতে পেরেছি। পোলট্রি খামার চালু করার সময় লালমনিরহাটের কোথাও পোলট্রি ফিড পাওয়া যেত না, পাশের জেলা কুড়িগ্রাম থেকে আনতে হতো। এছাড়া ডিম বিক্রি করতে সব সময় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। একপর্যায়ে ডিমগুলো কুড়িগ্রামে বিক্রি করা শুরু করি। এই তো, এটুকুই!
শেয়ার বিজ: আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন কোথা থেকে?
উত্তমা রায়: ছোট পরিসরে ব্যবসা চালানোর কারণে ব্যাংকঋণ নিইনি। নিজেদের জমানো অর্থ দিয়েই ব্যবসা চালু করি। বর্তমানে এনজিও থেকে কিছু অর্থঋণ করেছি।
শেয়ার বিজ: বর্তমান সমস্যা কী…
উত্তমা রায়: মাঝেমধ্যে হঠাৎ খাদ্যের দাম বেড়ে যায়, ডিমের দাম কমে যায়। তখন সমস্যায় পড়ি। এছাড়া আমার ডেইলি ফার্মে প্রতিদিন ২৫০ লিটার দুধ হয়। আশপাশের কয়েকজন নারী দুই থেকে তিনটি করে গাভী পালন করেন। কিন্তু লালমনিরহাটে কোনো চিলিং পয়েন্ট (দুধ শীতলীকরণ কেন্দ্র) না থাকায় দুধ বিক্রি করতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
শেয়ার বিজ: নারী উদ্যোক্তা বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন?
উত্তমা রায়: নারীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, অধিকাংশ নারীর কোনো নিজস্ব সম্পদ নেই। ব্যাংকঋণ চাওয়া হলে মর্টগেজ চায়। কিন্তু অনেক নারীর পক্ষে মর্টগেজ দেওয়া সম্ভব নয়। এতে অনেক উৎসাহী নারী উদ্যোক্তা পিছিয়ে পড়েন। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে যদি মর্টগেজ ছাড়াই ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়বে।
শেয়ার বিজ: নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতি কোনো পরামর্শ…
উত্তমা রায়: প্রতিষ্ঠানের আকার ছোট কিংবা বড় হোক, তা কোনো বিষয় নয়। প্রতিষ্ঠানকে সন্তানের মতো ভালোবাসতে হবে। এভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারলে অবশ্যই সফল উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব।
শেয়ার বিজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা স্বপ্ন…
উত্তমা রায়: আমার ডেইরি ফার্মে যেন ২০০টি গাভী থাকে। একটি চিলিং পয়েন্ট স্থাপন করার ইচ্ছা আছে। এছাড়া আগামীতে একটি মিষ্টির দোকান দেবো।