বিটুমিনের মান নিয়ে সওজ এলজিইডি ও ঠিকাদারদের দ্বন্দ্ব

ইসমাইল আলী: সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে ৮০-১০০, ৬০-৭০ নাকি ৩০-৪০ গ্রেড কোন মানের বিটুমিন বেশি উপযুক্ত? এ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) এবং ঠিকাদাররা। স্থানীয় সরকার বিভাগে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ নিয়ে বিপরীতধর্মী মতামত প্রদান করেন সওজ, এলজিইডি ও ঠিকাদারদের প্রতিনিধিরা, যদিও কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক।

এতে সওজ, এলজিইডি ছাড়াও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), গণপূর্ত অধিদফতর, ইস্টার্ন রিফাইনারি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবং ঠিকাদারদের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক ডিন ড. মোহাম্মদ জাকারিয়া। তিনি বলেন, সওজ, এলজিইডি ও বিভিন্ন সিটি করপোরেশন সড়কে বিটুমিন ব্যবহার করে। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যায় রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। পরিবর্তিত আবহাওয়ার কারণে বিটুমিনের সঠিক গ্রেড বাছাই করা প্রয়োজন। সাধারণত ৮০-১০০, ৬০-৭০ ও ৩০-৪০ গ্রেডের বিটুমিন পাওয়া যায়। যদিও জলবায়ু ও ট্রাফিক ব্যবস্থায় ৮০-১০০ গ্রেডের চেয়ে পেনিট্রেশন গ্রেডের বিটুমিন বেশি উপযুক্ত। আর বিমানবন্দর ও এক্সপ্রেসওয়ের মতো বিশেষ এলাকায় ৪০-৫০ ও ৩০-৪০ গ্রেডের বিটুমিন বেশি ব্যবহার করা যেতে পারে।

সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বেলায়েত হোসেন বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। তবে দেশে যানবাহন বেশি চলাচলের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। ওভারলোডেড যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে সড়ক টিকিয়ে রাখা কঠিন।

এদিকে সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান বলেন, দেশে বর্তমানে সাড়ে তিন লাখ টন বিটুমিনের চাহিদার বিপরীতে এক লাখ ২০ হাজার টন দেশে উৎপাদিত হয়। অবশিষ্ট দুই লাখ ৩০ লাখ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এক্ষেত্রে সড়কে ভারী যানবাহন চলাচল করলে বিটুমিনের গ্রেডে পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া অতিরিক্ত ভারবাহী যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সড়ক টিকবে না।

এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুর রশীদ খান বলেন, বর্তমানে ৮০-১০০ ও বিশেষ ক্ষেত্রে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন শক্ত হয়ে থাকে। এটি বৃষ্টির পানিতে সহজে ক্ষয় হয় না ও স্থায়িত্ব বেশি। তবে দেশে বিটুমিন না পাওয়ায় ইরান থেকে এটি আমদানি করা হয়, যার মান ভালো নয়। এজন্য মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। একই ধরনের মন্তব্য করেন এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মহসীন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরতউল্লাহ।

এলজিইডির পরামর্শক মো. আবুল বাশার বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রয়োজনীয় বিটুমিন সরবরাহ করতে না পারায় বিদেশ থেকে বিটুমিন আমদানি করা হয়। সেক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য সমন্বিত পদ্ধতি দরকার, যাতে গুণগত মান নিশ্চিত করা যায় ও সড়কের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়।

যদিও ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আক্তারুল হক ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, গত ১০ বছরে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন ছিল ৩৩ হাজার ৯৬৮ টন, যার প্রায় পুরোটাই বিক্রি করা হয়েছে। আর ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন করা হয়েছে চার লাখ ৯৮ হাজার ৪২৯ টন, যার প্রায় পুরোটাই বিক্রি হয়ে গেছে। তবে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিনের চাহিদা কম আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন চায় নির্মাতা সংস্থাগুলো।

তিনি আরও বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিন পরীক্ষাগারে টেস্ট করে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। তবে ইরান থেকে আমদানি করা বিটুমিনের মান নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন মীর আক্তার লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ রাশিদুজ্জামান, আবদুল মোনেম লিমিটেডের প্রতিনিধি  প্রকৌশলী আর কে দেবাশীষ ও নাভানী লিমিটেডের প্রতিনিধি ইঞ্জিনিয়ার আকবর আলী।

সৈয়দ রাশিদুজ্জামান বলেন, বিটুমিনের পাশাপাশি সড়কের ড্রইং ও ডিজাইন না থাকায় সড়ক ব্যবহারের অনুপযোগী হচ্ছে। বর্তমান চাহিদার আলোকে সড়কের ড্রইং ও ডিজাইন সংশোধন করা প্রয়োজন। আর কে দেবাশীষ বলেন, আমদানি করা বিটুমিনের মান বুয়েট পরীক্ষায় ভালো। সড়কের মান ভালো করার জন্য শুধু বিটুমিন নয়, ব্যবহƒত পাথর ও অন্যান্য উপাদান ভালো হওয়া প্রয়োজন।

ইঞ্জিনিয়ার আকবর আলী জানান, দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে সড়কগুলোর ড্রইং, ডিজাইন ও সব নির্মাণসামগ্রীর মানোন্নয়নের পাশাপাশি সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। একই সঙ্গে বিটুমিনের পরিমাণও সঠিক থাকতে হবে।

সব পক্ষের মতামতের প্রেক্ষিতে বৈঠকের সভাপতি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবদুল খালেক বলেন, বিটুমিনের মানোন্নয়নের পাশাপাশি অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর মানোন্নয়ন ও একই সঙ্গে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মালবাহী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়া এলজিইডির রোড ডিজাইন অ্যান্ড পেভমেন্ট স্ট্যান্ডার্ড বিষয়ে বুয়েট কর্তৃক চূড়ান্ত ম্যানুয়েল প্রণয়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ম্যানুয়েলের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বুয়েট। এটি চূড়ান্ত হলে তার ভিত্তিতে বিটুমিনের ব্যবহার বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০