সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: রড, চ্যানেল, বার ও অ্যাঙ্গেল উৎপাদনের জন্য গত বছরের ২৪টি বাল্ক জাহাজে কাঁচামাল আমদানি করে বিএসআরএম গ্রুপ। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে একটি জাহাজও চট্টগ্রাম বন্দরের বার্থিংয়ের সুযোগ পায়নি। এসব জাহাজকে কমপক্ষে এক দিন থেকে সর্বোচ্চ ৭০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য গ্রুপটিকে প্রায় ৬০ কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হয়। শুধু এ গ্রুপ নয়, গত দেড় বছরের প্রায় চার হাজার জাহাজকে কম-বেশি অতিরিক্ত সময় অপেক্ষার জন্য জরিমানা দিতে হয়। এর পরিমাণ প্রায় ৩১৯ কোটি টাকা, যার পুরোটাই ব্যবসায়ীদের বহন করতে হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, দেশের অর্থনীতির প্রাণখ্যাত চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতি বছরই বাড়ছে পণ্যবাহী জাহাজ হ্যান্ডলিং। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৯৯০টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৯২টি জাহাজ। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৮৭৫টি জাহাজ। এক্ষেত্রে বন্দরের সাধারণ কার্গো বার্থ ১২টি জেটিতে সর্বোচ্চ সাড়ে আট মিটার ড্রাফটের (জাহাজের পানির অংশের গভীরতা) জাহাজ ভেড়ানো যায়। আর চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল ও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যায়। এ নির্ধারিত গভীরতার বেশি জাহাজ ভেড়ানো যায় না।
পাশাপাশি পণ্য খালাসে বন্দরে অত্যাবশ্যক ভারী যন্ত্রপাতির সংকট, প্রয়োজনীয় লাইটার জাহাজ সংকট, গিয়ারলেস জাহাজ আগমনের আধিক্য, প্রতি বছর কনটেইনারের প্রবৃদ্ধি অনুপাতে স্থান সংকট এবং বেসরকারি কনটেইনার ইয়ার্ডগুলোর (অফডক) অনিয়ম ও অদক্ষতার পরিণামে বন্দরে জাহাজ জট দেখা যায়। এ অবস্থায় বন্দরে জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও বহির্নোঙরে অলস ও বর্ধিত সময় নিয়ে অপেক্ষায় থাকার জন্য একেকটি জাহাজকে দৈনিক গড়ে ১০ হাজার ডলার থেকে ৭৪ লাখ ডলার পর্যন্ত জরিমানা দিতে হচ্ছে। আর এ কারণে সামগ্রিকভাবে বন্দরের আয় বাড়লেও ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকদের গত দেড় বছরে তিন হাজার ৯৯২টি জাহাজের জন্য ৩১৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা জরিমানা হিসেবে ব্যয় করতে হয়। এতে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীদের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। এর আর্থিক খেসারত বা ক্ষতি গুনতে বাধ্য হচ্ছে দেশের ক্রেতাসাধারণ।
বিএসআরএম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক তপন সেনগুপ্ত শেয়ার বিজকে বলেন, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে গত দুই বছরের অধিক সময় ধরে সক্ষমতা ও অবকাঠামোগত সংকটের কারণে পণ্যবাহী জাহাজগুলোর অপেক্ষমাণ সময় বৃদ্ধি পায়। এতে নির্দিষ্ট সময়ে বার্থিং সুবিধা না পাওয়ায় প্রতিটি জাহাজকে আর্থিকভাবে ক্ষতিপূরণ গুনতে হয়। আমাদের গ্রুপের গত বছরের (২০১৭ সালে) আমদানি করা কাঁচামালবাহী ২৪টি জাহাজের অতিরিক্ত সময় অবস্থানের জন্য মোট ৭৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬৬০ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধ করতে হয়। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৫৯ কোটি ৮৯ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ টাকা। আর ২০১৬ সালে ১২টি জাহাজের অতিরিক্ত অবস্থানের কারণে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১২ লাখ দুই হাজার ৯৭০ ডলার পরিশোধ করতে হয়েছিল। এগুলো খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে এক দশকে নতুন জেটি, ইয়ার্ড ও টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়নি। সর্বশেষ জেটি নির্মাণ করা হয় ২০০৭ সালে। এরপর সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানোর জন্য আর কোনো জেটি নির্মাণ করা হয়নি। এখন পর্যন্ত নতুন কোনো জেটি নির্মাণের কাজও শুরু হয়নি। ২০০৫ সালে কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল বা কেসিটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়, যদিও এটি বাস্তবে রূপ নেয়নি। আবার পতেঙ্গায় লালদিয়া চরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘লালদিয়া বাল্ক টার্মিনাল’ নির্মাণের পরিকল্পনা ছয় বছর আগে নেওয়া হলেও নানা কারণে এর নির্মাণ কার্যক্রম অনেকবার পিছিয়েছে। একইভাবে ইয়ার্ড নির্মাণেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। আধুনিক যন্ত্রপাতিরও অভাব রয়েছে দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দরে।
যদিও এর সঙ্গে একমত নন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি বন্দরের এক অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালিদ ইকবাল বলেন, আগামী পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে, যা এককভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষ জোগান দিতে পারবে না। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) এবং বিদেশি অর্থায়নের মাধ্যমে এটি পূরণ করা দরকার হবে। তিনি আরও বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে যন্ত্রপাতি কেনার প্রক্রিয়ায়ও আমরা এগিয়েছি। এছাড়া পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল ও লালদিয়া বাল্ক টার্মিনালের কাজ অচিরেই শুরু হবে। বে-টার্মিনালের সমীক্ষা প্রতিবেদন কাজও শেষের দিকে। পাশাপাশি মিরসরাই-সীতাকুণ্ড এলাকায় ছোট আকারের বন্দর নির্মাণের সম্ভাব্যতা নিয়ে সমীক্ষা চলছে। সব মিলিয়ে বন্দরের সক্ষমতা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হবে।