ইসমাইল আলী: চীনের অর্থায়নে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হবে টানেল। জিটুজি ভিত্তিতে এটি নির্মাণ করবে দেশটির চায়না কমিউনিকেশন কন্সট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটি অনুমোদিত হলেও এখনও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি, যদিও টানেল নির্মাণ ব্যয় বেড়ে চলেছে। এতে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়।
তথ্যমতে, দেশের প্রথম টানেল নির্মাণে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) চূড়ান্ত করা হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। সিসিসিসি ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান অরূপ প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতেই এ ব্যয় চূড়ান্ত করে। তখন টানেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থায়নের নিশ্চয়তা না থাকায় সে সময় তা ফেরত দেয় পরিকল্পনা কমিশন।
পরে সিসিসিসির সঙ্গে চুক্তি করে সেতু বিভাগ। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ২০১৫ সালের জুনে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় সাত হাজার ৭৮৪ কোটি ছয় লাখ টাকা। তবে সিসিসিসির কিছু প্রস্তাবে আপত্তি তোলে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)। তবে এর পর নির্মাণব্যয় না কমে উল্টো বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকায়। সে বছর নভেম্বরে প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়।
দুই বছর পেরুলেও এখনও টালেনের নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। এরই মধ্যে আবারও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে সেতু বিভাগ। এতে দেখা যায়, নতুন হিসাবে টানেলটি নির্মাণে ব্যয় পড়বে প্রায় ১০ হাজার ২৯৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ছে এক হাজার ৮৪৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা অর্থাৎ ২১ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
নতুন প্রস্তাবে প্রকল্পটিতে পাঁচ হাজার ৮৫১ কোটি আট লাখ টাকা ঋণ দেবে চীনের এক্সিম ব্যাংক। বাকি চার হাজার ৪৪৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহ করতে হবে।
ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির জন্য অতিরিক্ত ৬৪ দশমিক ৪৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এতে এক হাজার ১৪৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় বাড়বে। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মোট চুক্তিমূল্যের ১৩ শতাংশ হারে ভ্যাট ও কর পরিশোধ করতে হবে। এ বাবদ ব্যয় বাড়ছে ৭০৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া ৫০ কোটি টাকার সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি টিম ও তিন কোটি ৮১ লাখ টাকা পরিষেবা সংযোগ সেবা স্থানান্তর বাবদ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে দুটি নতুন গাড়ি যুক্ত হয়েছে। আর নির্মাণকালীন সুদ বাবদ ৪৯৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা বাদ দেওয়া হয়েছে।
এর বাইরে টানেল ও টোল প্লাজা নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে যথাক্রমে ৭৯ কোটি ৪৭ লাখ ও ১৩৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এছাড়া সার্ভিস এলাকা বাবদ ১৩ কোটি ৬৭ লাখ ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বাবদ ৮০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ছে। তবে সেতু/ভায়াডাক্ট বাবদ ১৯ কোটি ৬৮ লাখ ও টানেল অ্যাপ্রোচ বাবদ ১২ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয় কমছে।
জানতে চাইলে কর্ণফুলী টানেলের ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক কবির আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সেতু বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, কর্ণফুলী টানেলের জন্য জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বাড়ছে। এছাড়া এনবিআর চুক্তি মূল্যের ওপর নতুন করে ভ্যাট ও কর আরোপ করেছে। আরও কিছু নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি সংশোধন করা হচ্ছে। শিগগিরই এ প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।
সেতু বিভাগের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জানান, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে যৌথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে চীনের সিসিসিসি ও হংকংয়ের অরূপ কন্সট্রাকশনস। ২০১৩ সালের শেষ দিকে এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেয় প্রতিষ্ঠান দুটি। এর ভিত্তিতেই প্রকল্পটির ডিপিপি ও নির্মাণ ব্যয় চূড়ান্ত করা হয়। এর সিসিসিসি টানেল নির্মাণ করছে ও অরূপ কন্সট্রাকশন পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। ফলে দফায় দফায় ব্যয় বৃদ্ধি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটির আওতায় নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি গাড়ি, ১২টি বাইক ও একটি টাগবোট কেনায় ব্যয় হবে ৮৩ কোটি টাকা। আবার সেগুলোর জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণে সাত কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হবে। এর পুরোটাই চীনের ঋণে বহন করা হবে। আবার দেশটির ঋণে ৩৯০ কোটি ৮৭ টাকা সার্ভিস এরিয়ার জন্য জমি ভাড়া নেওয়া হবে। যদিও সম্ভাব্যতা যাচাইকালে এ খাতে ব্যয় ছিল মাত্র ৫০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের আওতায় ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার সরবরাহ করবে সিসিসিসি। এতে ব্যয় হবে ২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অথচ পদ্মা সেতুর জন্য একই ধরনের সফটওয়ার কেনা হয়েছে দুই কোটি ১৭ লাখ টাকায়। যদিও প্রাথমিকভাবে ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার সরবরাহে কোনো প্রস্তাব করেনি সিসিসিসি। গত মার্চে টানেল নির্মাণে আর্থিক প্রস্তাব দেওয়ার সময়ও সফটওয়্যার কেনার প্রস্তাব ছিল না সিসিসিসির। তবে গত জুনে প্রকল্প ব্যয় চূড়ান্ত করে সফটওয়্যার ও টাগবোট কেনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রকল্পটির চুক্তিপত্রে দেখা গেছে, সিসিসিসির প্রস্তাবনায় ১২টি অংশে ব্যয় বিশ্লেষণ করা ছিল। এর বাইরে পরিশিষ্ট অংশে অতিরিক্ত পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ ডলার বা ৪৯১ কোটি টাকা ব্যয় নতুন করে যুক্ত করেছে সেতু বিভাগ। এ ব্যয় পুরোটাই বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় বহন করা হবে। এর বাইরে প্রকল্প অফিস নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, গাড়ি চালকদের বেতন ও গাড়ি রাখার শেড নির্মাণ, বিনোদন বাবদ ব্যয়, গৃহকর্মীদের বেতন, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয়, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ বিলসহ সব ধরনের ব্যয় চীনের বায়ার্স ক্রেডিটের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে এসব ব্যয়ের অর্থ সরকারকে সুদসহ পরিশোধ করতে হবে।