নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হয়নি; সম্ভবত তা হবেও না। তবে যেসব সমস্যা ব্যাংক খাতকে খেয়ে ফেলছে, তা নিরসনে একটি ‘ইনকোয়ারি কমিশন’ গঠন করা জরুরি। কারণ রোগ লুকিয়ে রাখা যায় না। এটি প্রকাশ হবেই। এ ক্ষেত্রে সুচিকিৎসার বিকল্প নেই। এ ছাড়া সাত ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। এটি উদ্বেগজনক।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে বার্ষিক ১৯টি গবেষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বক্তারা।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী ও বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ দুটি সেশন চেয়ার ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএ চৌধুরী একটি সেশন চেয়ারের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাংক খাতের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মোট ১৯টি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এসব গবেষণার ওপর আলোচনায় অংশ নেন ব্যাংক এশিয়ার এমডি মো. আরফান আলী, প্রাইম ব্যাংকের সাবেক এমডি আহমেদ কামাল খান চৌধুরী, বিআইবিএমের সুপার নিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী, বিআইবিএমের সুপার নিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হয়নি। সম্ভবত হবেও না। এখন অন্তত একটি ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করা যায় কি-না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। যার মাধ্যমে সমস্যাগুলো দূর করা যেত। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের সমস্যা সবার জানা। প্রধান সমস্যা সুশাসনের ঘাটতি। সততা নেই। কিছু ব্যাংকের মালিক, রাজনৈতিক লোকজন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন খেয়ে ফেলেছে। তা না হলে মূলধন ঘাটতি হতো না। তিনি বলেন, রোগ লুকিয়ে লাভ নেই। এটি বের হবেই। তাই রোগ না লুকিয়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
এসএ চৌধুরী বলেন, সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে। প্রায় সবগুলো ব্যাংক সরকারি। এটি উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, ১৯৭২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬১ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। সরকারি ব্যাংকের বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সরকারি ব্যাংকে ১৬ হাজার লোক নেই। প্রতিবছর এক হাজার ৮৯০ জন অবসরে যাচ্ছেন। কিন্তু সে তুলনায় দক্ষ জনবল নিয়োগ হচ্ছে না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিপুল অংকের অর্থ সরকারের কাছে আটকে আছে। শুধু সোনালী ব্যাংকেরই আটকে আছে ৯ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান খোলার পরামর্শ দেন তিনি।
হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া গৃহঋণ দেওয়া যাবে না। পরিচালনা পর্ষদের চাপে অনেক সময় টপ ম্যানেজমেন্ট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়। সে কারণে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়া হয়। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাংক বিপদে আছে। মূলত এটি করা হচ্ছে ওপরের চাপে। তিনি বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিং প্রসারের পাশাপাশি ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। এটা কমিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। বিদেশি ঋণে খেলাপি অনেক বেড়ে গেছে। যা নতুন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আউটলেট এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শাখা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইয়াছিন আলি বলেন, এক ব্যাংকের ঋণ অন্য ব্যাংকের কেনার প্রথা বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না। এটি মূলত নতুন ৯ ব্যাংক বেশি করেছে। তিনি বলেন, গৃহঋণ খুবই লাভজনক। এটি জিডিপিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলো ভাবতে পারে।
আরফান আলী বলেন, দীর্ঘমেয়াদি গৃহঋণ বেশি গেলে ঝুঁকি বাড়বে। এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেশি মুনাফা দেখাতে প্রলোভন দেখিয়ে এক ব্যাংকের ঋণ অন্য ব্যাংক কিনে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। এতে বেড়ে যাচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। যা কারও জন্য কাম্য নয়। তিনি বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজে কৃষিঋণ বিতরণ করা যাচ্ছে।
আহমেদ কামাল খান চৌধুরী বলেন, অবৈধ পথে টাকা আসা বা হুন্ডির কেন্দ্রবিন্দু বিকাশ। যদিও ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করে আসছে; কিন্তু আজ তা প্রমাণিত। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ ব্যাংক মূলধন সংকটে আছে। মূলধন সংকট থাকলে একীভূত করা সম্ভব নয়।
বক্তারা বলেন, ব্যাংকের মালিকরা একীভূত চান না। কারণ অনেকে সরাসরি ও গোপন সুযোগ-সুবিধা পান। একীভূত হলে সে সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া তাদের ধারণা, যত দুর্নীতি-লুটপাট হোক, যত অর্থশূন্য হোক, তাতে ব্যাংক কোনোদিন বন্ধ হবে না। কারণ ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের। সে কারণে তারা একীভূত হতে চাইছে না। তারা বলেন, গত কয়েক বছরে বিপুল অংকের অর্থ মূলধন ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে। এসব অর্থ সবই জনগণের। এভাবে আর কত চলবে প্রশ্ন তাদের।