নিজস্ব প্রতিবেদক: ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) ত্রৈমাসিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৭) বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেকসই ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য জরুরি।
এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে পার ক্যাপিটা বিদ্যুতের ব্যবহার ৪৩৩ কিলোওয়াট; এ হার বিশ্বে সর্বনিম্ন বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭২ সালে মাত্র ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ হাজার ৪৬ মেগাওয়াট।
সরকারের সহায়ক নীতির কারণে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ ও স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের ৪৬ শতাংশ স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা উৎপাদন করছে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সফলতা এনেছে কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ পদ্ধতি দুর্বল হওয়ায় সিস্টেম লসের কারণে মাত্র ৯ হাজার ৫০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে।
২০১৫ সালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ খাতের ‘মাস্টারপ্ল্যান-২০১৫’ অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে ৫৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ কয়লাভিত্তিক, ৩৫ শতাংশ গ্যাস এবং এলএনজিভিত্তিক ও অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার (পাঁচ শতাংশ), আমদানিকৃত তেল (পাঁচ শতাংশ) এবং রিনিউঅ্যাবল এনার্জির (২০ শতাংশ) মাধ্যমে উৎপাদিত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকার ১৫ হাজার মেগাওয়াট এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বার্ষিক সাত মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির জন্য বেসরকারি খাতের মালিকদের সঙ্গে ইতোমধ্যে চুক্তি সই হয়েছে।
২০৪১ সালের মধ্যে ২২ হাজার মেগাওয়াট আমদানিকৃত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ এগিয়ে চলছেÑএজন্য বছরে ৬৬ মিলিয়ন টন কয়লার প্রয়োজন হবে। সরকার মাতারবাড়ীতে বার্ষিক ৪০ মিলিয়ন টন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা ট্রান্সফার টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া রূপপুরে ১২০০ মেগাওয়াট নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ গত ৩০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলোর পাঁচটি কয়লা ক্ষেত্রে তিন বিলিয়ন টন উন্নতমানের কয়লা মজুত থাকা সত্ত্বেও সরকার কয়লা আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও এনার্জিবিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা মাইনিংয়ের জন্য সমর্থন দিয়েছে, যেহেতু এ প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি কম এবং খরচ কম। কিন্তু এ পদ্ধতির বিরোধিতাকারীদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে অগ্রসর হচ্ছে না।
কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে ফান্ড সীমিতকরণের প্রতিশ্রুতি থাকলেও চীন, ভারত, জাপান, ফিলিপাইনস ও ভিয়েতনামসহ অন্যান্য এশিয়ার দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য ক্রমেই কয়লার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
বিশ্ব কয়লা অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে বর্তমানে চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া ৭১ শতাংশ বিশ্বের নতুন আবিষ্কৃত কয়লা পোড়াচ্ছে।
লোডশেডিং ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার জন্য শিল্প উৎপাদন ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায়, লোডশেডিংয়ের ফলে শিল্প খাতে বছরে এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ কম হচ্ছে। এটা অনুমান করা হয় যে, মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার বার্ষিক মূল্য ২৪৭ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। সুতরাং উপযুক্ত অবকাঠামো এবং কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার বিবেচনাযোগ্য হাইড্রোপাওয়ারের সম্ভাবনা হিমালয়ান অঞ্চল যেমনÑনেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তরের রাজ্যগুলোতে আছে। নেপালে এককভাবে ৮৩ হাজার মেগাওয়াট হাইড্রোপাওয়ার উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু যতটুকু জানা যায় সেদেশে মাত্র দুই শতাংশেরও কম হাইড্রোপাওয়ার উৎপাদন বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। ভুটানের ৩০ হাজার মেগাওয়াট হাইড্রোপাওয়ার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এ ব্যাপক হাইড্রোপাওয়ার সম্ভাবনার অনুসন্ধানে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশও সম্পৃক্ত হতে পারে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে এবং স্থানীয় কয়লা উত্তোলনে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় টেকসই স্থানীয় প্রাথমিক এনার্জির উৎসে পৌঁছানো ক্রমেই দুরূহ হয়ে যাচ্ছে। এক প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে আমদানিকৃত জ্বালানির ওপর ৯২ শতাংশ নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, যদি স্থানীয় কয়লা অনুসন্ধান করা না যায় এবং কাজে লাগানো না যায়।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যকর এবং সাশ্রয়ী হবে যদি আমদানিকৃত কয়লার পরিবর্তে স্থানীয় উচ্চমানসম্পন্ন কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহƒত হয়। সুতরাং বিদ্যুৎ খাতকে অর্থনীতির মেরুদণ্ড, টেকসই ও উজ্জীবিত করতে হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোতভাবে কয়লার বাণিজ্যিক অনুসন্ধানে বাংলাদেশকে যেতে হবে।
টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ
