সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: ২০১৩ সালের মাঝামাঝি কর্ণফুলী ড্রেজিংয়ের মালয়েশিয়ান ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেলে থমকে গিয়েছিল কাজ। এরপর নানান জটিলতায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহুল আলোচিত কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু হয়নি পাঁচ বছরেও। এর মধ্যে গত এক বছর ধরে শোনা যাচ্ছিল নতুনভাবে কর্ণফুলী ড্রেজিংয়ের প্রকল্প শুরু হবে। অথচ এ সময়ে ভরাট হয় কর্ণফুলী। জেগে ওঠে চর। আর কমেছে পানি ধারণের ক্ষমতা। এতে বন্দরে বড় আকারের জাহাজ প্রবেশ সীমিত হয়ে পড়েছে। একই কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই চট্টগ্রাম শহরের অনেক এলাকা পানিতে ডুবে থাকে।
সূত্র জানায়, দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে কর্ণফুলী নদী। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে জাহাজ চলাচল নির্ভরশীল কর্ণফুলী নদীর নাব্যের ওপর। আর দেশের মোট আমদানি-রফতানির ৯০ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই হয়ে থাকে। কিন্তু চার বছর ধরে বড় ধরনের খননকাজ না হওয়ায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশ প্রায় ভরাট হয়ে গেছে।
নাব্য রক্ষায় ২০১১ সালে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু করা হয়। কিন্তু ড্রেজিংয়ের মাঝপথে ২০১৩ সালে মালয়েশিয়ান ঠিকাদার টাকা নিয়ে উধাও হলে থমকে যায় কাজ। আইনি জটিলতায় বন্ধ থাকা খননকাজ ফের শুরু করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে চার বছর পর। ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পেলে খননকাজ ফের শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। আর জনগুরুত্বপূর্ণ এ খননকাজের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ আইনি জটিলতা এড়াতে প্রকল্পের নতুন নাম দিয়েছে। আর তা উম্মুক্ত দরপত্রের বদলে ডিপিএম বা সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে নৌবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ারচর ড্রেজিং’ নামের এ প্রকল্প ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে কয়েক মাস আগে জমা হয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, যা দ্রুতই অনুমোদন পাবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পের সারসংক্ষেপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করতে খরচ হতে পারে ৪৩৪ টাকা। আর সদরঘাট থেকে বাকলিয়ারচর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও প্রায় ২৫০ মিটার চওড়া এলাকা থেকে ৪২ লাখ ৮০ হাজার ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করতে হবে। এ মাটি উঠানোর পর এখানকার পানির গভীরতা হবে সমুদ্র সমতল থেকে চার মিটার। শুধু ড্রেজিংয়েই শেষ নয়, ড্রেজিং শেষ হওয়ার পর পরবর্তী তিন বছর তা দেখভালও করতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। আর প্রকল্প খরচ দেখানো হয়েছে ২৫৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এত বড় খননকাজের জন্য নৌবাহিনীর নিজস্ব ড্রেজার বা যন্ত্রপাতি না থাকায় চীনের হারবার মেরিনের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। খননকাজ শেষ হলে কর্ণফুলী নদীর সদরঘাটে চারটি লাইটার বা ছোট জাহাজ ভেড়ার জেটি চালু করা সম্ভব হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় চার বছর ড্রেজিংয়ের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কর্ণফুলীতে চর জেগে উঠছে। গুরুত্বপূর্ণ চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের সঙ্গে নৌপথে যোগাযোগ রক্ষাকারী চাক্তাই ও রাজাখালী খাল ভাটার সময় সম্পূর্ণ পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এতে প্রায় মাঝ নদী পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যায়। এছাড়া বিশেষ করে বেশি পলি জমা পড়েছে বাকলিয়া কল্পলোক আবাসিক এলাকার পেছন থেকে সদরঘাট লাইটারেজ জেটির আগ পর্যন্ত। আর পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় ভাটার সময় কর্ণফুলী সেতুর চাক্তাই অংশে নদীর চ্যানেলের গভীরতা কমে গেছে প্রায় তিন ফুট। এতে চ্যানেলের বাইরে আরও বেশি পলি জমা থাকায় চ্যানেল থেকে জাহাজ বা বোটপণ্য ওঠানামা করানোর জন্য তীরে ভিড়তে পারছে না। এতে নদীর মাঝখানে জোয়ারের জন্য জাহাজ ও বোটগুলোকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, কর্ণফুলী নদীর নাব্য বাড়িয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ২০১১ সালে ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং পপ্র্রকল্প’ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ২০১১ সালের জুনে শুরু হওয়া এ কাজ ২০১২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজের অগ্রগতি ঠিকমতো না হওয়ায় দু’দফা সময় বাড়ানো হয়। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ২০১৪ সালের মাঝামাঝি বন্দর কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ বন্ধের নির্দেশ দেয়। চুক্তি বাতিল করায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালতে মামলা করে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ মামলা চলতে থাকে এবং আইনি নিষেধাজ্ঞায় বন্ধ থাকে খননকাজ। নদীর নাব্য ব্যাপকভাবে কমে গেলেও আইনি বাধায় খননকাজ শুরু করতে পারছিল না বন্দর কর্তৃপক্ষ। এখনও চূড়ান্ত রায় হয়নি। ফলে এখনও কাটেনি জটিলতা।
ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ বন্ধ থাকায় পলি জমার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তারা বলেন, নাব্য ফিরলে বড় জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারবে, ছোট জাহাজ বেশি পরিমাণে নদীতে নোঙর করতে পারবে, নদীর তীরে চারটি লাইটার জেটি চালু হলে বহির্নোঙর থেকে আনা পণ্য জেটিতে নামানো অনেক সহজ হবে। এতে পণ্য খালাসের খরচও কমবে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম মহানগরের বর্ষায় যে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়, তা অনেকাংশে কমে আসবে।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমদ শেয়ার বিজকে বলেন, নগরীর চাক্তাই-রাজাখালী খালসহ গুরুত্বপূর্ণ খালের মুখগুলো ভরাট হয়ে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং না হওয়ায় খালগুলো সরু হয়ে গেছে। ফলে এ বছর স্মরণকালের সর্বোচ্চ ক্ষতির আশঙ্কায় আছে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। আর কর্ণফুলীর ড্রেজিং শুরু হবে হবে শুরু শুনছি এক বছর ধরে। কিন্তু বাস্তবে কবে শুরু হবে, তা জানি না। এছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি বৃহৎ প্রকল্পের কাজও এপ্রিলে শুরু হবে শুনেছিলাম। কিন্তু এখনও শুরু হয়নি। আসলে জনপ্রতিনিধিরা আমাদের খালি বুঝ দিয়ে যাচ্ছেন।
কবে নাগাদ তা শুরু হতে পারে এমন প্রশ্নে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নানান জটিলতার কারণে নতুনভাবে কর্ণফুলী নদীতে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করা যায়নি। তবে চলতি সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওনা যেতে পারে। আর অনুমোদন পেলেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজ শুরু হবে। আর এ প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এ খননকাজ নৌবাহিনীর সহযোগিতায় করা হবে।