নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বাড়ির মালিকদের অনেকেই সঠিকভাবে কর দেয় না। করজাল বাড়াতে এসব বাড়ির মালিকদের আগামীতে করের আওতায় আনার প্রস্তাব করেছে ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশন। বাজেটে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে; না হলে বাজেটের পর বাড়ি মালিকদের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।
একই সঙ্গে দেশে লাখ লাখ ট্রেড লাইসেন্সধারীকে করের আওতায় আনার প্রস্তাব করলে এনবিআর এ বিষয়েও কাজ করবে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান। গতকাল এনবিআর সম্মেলন কক্ষে এনবিআরের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশন এসব প্রস্তাব করে। সভায় পেশাজীবী সংগঠন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন, শিপ বিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশন, শিপ ব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল মতিন রাজস্ব আদায় বাড়াতে করজাল বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বাড়ির মালিকদের অনেকেই করের আওতায় নেই। থাকলেও অনেকেই সঠিকভাবে কর দেয় না। তাদের করের আওতায় আনতে সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স জমা দেওয়ার সময় আয়কর রিটার্ন জমার সিøপ বা সনদপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলে এখান থেকে কয়েক লাখ করদাতা পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, লাখ লাখ ট্রেড লাইসেন্সধারী ব্যবসা করলেও তারা করের আওতায় আসছে না। ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া ও নবায়নের সময় রিটার্ন দাখিলের সিøপ প্রদান বাধ্যতামূলক করা হলে করদাতা বাড়বে। তিনি আয়কর বিভাগের জনবল বৃদ্ধি ও করদাতাদের সেবা নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেন।
এর জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অনেক বাড়ির মালিক তাদের সম্পদ অনুযায়ী কর দেয় না। প্রতিটি বাড়ির মালিকের যে পরিমাণ সম্পদ তাতে তাদের তো কর দেওয়া উচিত। বাজেটের সময় অর্থবিলে তা সংযুক্ত করা হবে; না হলে বাজেটের পর এ নিয়ে কাজ করা হবেÑএনবিআরের পরিকল্পনা রয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া ও নবায়নে ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা মানছে না। এ নিয়ে আমরা কাজ করব।
আবদুল মতিন বলেন, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনে করহার বেশি। সেজন্য অনেকেই ফ্ল্যাট কিনে রেজিস্ট্রেশন করেন না। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। এছাড়া সাইনিং মানির ওপর ১৫ শতাংশ উৎসে করারোপ করা আছে। কিন্তু জমি বিক্রিতে চার শতাংশ কর দিতে হয়। এতে একদিকে কর ফাঁকি হচ্ছে, অন্যদিকে কালো টাকার উৎপত্তি হচ্ছে। এ নিয়ে সরকার কাজ করলে রাজস্ব পেতে পারে।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, দেশের ১৮টি প্রাইভেট ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোস বা আইসিডি বর্তমানে প্রায় শতভাগ কন্টেইনারবাহী রফতানি পণ্য এবং ৩০ শতাংশ আমদানি পণ্য হ্যান্ডেল করে। দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের প্রায় ৩২ বিলিয়ন রফতানিমুখী তৈরি পোশাক আইসিডির মাধ্যমে বিদেশে রফতানি হয়। বর্তমানে উচ্চ করহারের ফলে এ আইডিসিগুলোর অপারেশনাল কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এ আইসিডিগুলোর কোম্পানি করহার ১০ শতাংশ ও উৎসে কর দুই শতাংশ করা এবং কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন তিনি।
এক্সপোর্ট ওরিয়েন্ট শিল্প বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবদুল্লাহ হেল বারী বলেন, বর্তমানে রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রতিকূল পরিবেশ পার করছে, লোকসান গুনছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শুল্ককর ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। তিনি দেশীয় যেসব কোম্পানির জাহাজ বিদেশে মালামাল পরিবহন করে তাদের কাছে জাহাজ বিক্রিকে রফতানি হিসেবে গণ্য করা এবং কর মওকুফ সুবিধা দুই বছর করার প্রস্তাব করেন তিনি।
শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন সচিব মো. সিদ্দিক বলেন, জাহাজভাঙা শিল্পের ওপর দুবার কর দিতে হয়। প্রথমে পুরোনো জাহাজ কেনার পর ওজনের ওপর শুল্ককর, দ্বিতীয়বার জাহাজের ভেতরে থাকা সামগ্রীর ওপর কর দিতে হয়। ফলে দুবার কর দিতে হচ্ছে। এছাড়া জাহাজের ওপর টনপ্রতি স্পেসিফিক ডিউটি এক হাজার ৫০০ ও অগ্রিম আয়কর ৮০০ টাকা করার প্রস্তাব করেন তিনি।
ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশের (আইসিএসবি) একজন প্রতিনিধি বলেন, বিদেশিরা অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে কনসালট্যান্সি করে টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশিরা বিদেশে কনসালট্যান্সি করে রেমিট্যান্স আনলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। এর কর প্রত্যাহার প্রয়োজন।
এর জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কনসালট্যান্সির নামে টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিদেশিরা এসে কাজ করে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। এ নিয়ে নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশে কর হিসেবে জিডিপির ১৫ শতাংশ এলেও আমাদের আসে মাত্র আট থেকে ৯ শতাংশ। আমাদের করের আওতা বাড়াতে হবে। তাদের আওতায় আনতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে কর ফাঁকির প্রবণতা রয়েছে। তা রোধ করা চ্যালেঞ্জ। বাজেট করার সময় রাজস্ব আয়ের বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সরকার বড় বড় প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে। এজন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এ অর্থের জোগান দিতে রাজস্ব বাড়াতে হবে।
বিশ্বের উন্নত দেশে নাগরিকদের সোশ্যাল সেফটিনেটের আওতায় পেনশন দেওয়া হয়। আমাদের দেশে করদাতাদের শুধু সোশ্যাল সেফটিনেটের আওতায় পেনশন ছাড়া আর সব নাগরিক সুবিধা দেওয়া হয়। বরং আরও বেশি সেবা পায়। তবে তা প্রচারিত হয় না। তা করদাতাদের জানাতে হবে। পর্যায়ক্রমে পেনশন সুবিধাও পাবেন। শিপ বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করা হয়। তারা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এ বিষয়ে আমাদের নজর থাকবে। রাজস্ব বাজেট পূরণে সবার সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।