ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-১০
মিজানুর রহমান শেলী: ঢাকা রাজধানী ও বাণিজ্যের দিক দিয়ে মোগল আমলে ছিল অনেক প্রসিদ্ধ। তবে মোগলদের সুবেদার নিয়োগে ঘন ঘন বদলি প্রথা ঢাকাকে মাঝে মধ্যেই পরিবর্তিত হতে বাধ্য করেছে। সুবেদাররা ঢাকাকে কিছুটা হলেও নিজেদের মতো করে সাজিয়েছেন। তবে ১৬১০ থেকে ১৭১৭ সালের আগ পর্যন্ত প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকার আভিজাত্য ছিল সনির্বন্ধ। এরপর ঢাকার আভিজাত্য দিনে দিনে সংকুচিত হতে থাকল। ইংরেজরা এসে এই ঢাকাকে প্রথমে ভালো চোখে দেখল না। কেননা, মোগলদের অভিজাত কোনো শহরের উন্নয়নকে তারা নিজেদের শোষণ প্রক্রিয়া আর আধিপত্যবাদের জন্য নিরাপদ মনে করেনি। তবে নিজেদের অবস্থান এই ভারতে যখন ধীরে ধীরে পাকা-পোক্ত হয়ে এলো, তখন অবশ্য ঢাকার মধুকরী সুধা পান করতে আর বিরত থাকতে তারা পারল না। রাজধানী নয়Ñতবে এখান থেকে তারা অর্থনৈতিক কারবার পরিচালনায় গতি বাড়িয়ে দিল। এই অঞ্চলের কাঁচামাল সংগ্রহ আর কাঁচামাল থেকে কিছু পণ্য উৎপাদনের কারখানা তারা গড়ে তুলল মাত্র। বাণিজ্য বা বাজার ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন এখানে তারা ঘটাল না। ঢাকাবাসীর ভাগ্যোন্নয়ন নিথর হয়েই রইল। পরে অবশ্য আঞ্চলিক প্রশাসন পরিচালনায় এখানে কিছু অবকাঠামো গড়ে তুলেছিল। এর সবকিছুই হয়েছিল ইংরেজদের প্রয়োজনে।
১৭১৭ সালে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে চলে যায়। ঢাকার গৌরব তখন থেকেই ক্ষীণ হতে থাকে। নায়েব নাজিমের আস্তানা আর পূর্ববাংলার মোগল সামরিক ও নৌবাহিনীর সদর দফতর ছাড়া আর ঢাকার তেমন গুরুত্ব রইল না। এর সঙ্গে ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ঢাকাকে কিছুটা জিইয়ে রেখেছিল। তবে তা পরিসর বৃদ্ধির জন্য তেমন কিছ্ইু না।
১৭৬৫ সাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি পেল। এ সময় থেকে কার্যত ঢাকার প্রধান পতন পর্ব শুরু হলো। এ সময় অবশ্য প্রাদেশিক বিচার বিভাগ ও আপিল দফতর ঢাকায় ছিল। ১৮২৮ সাল পর্যন্ত নগরটি ছিল কেবল একটি জেলা সদর। আঠারো শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের শুরুতে সুতিবস্ত্র বাণিজ্যের পতন যেন হাঁকিয়ে উঠল। ১৮৪০-এর দিকে চূড়ান্ত পতনে পৌঁছল।
ইংরেজ আমলে বেশিরভাগ মোগল শহরই হয়েছে পরিত্যক্ত-জঙ্গলাকীর্ণ। ঢাকাও এরকম অবহেলা থেকে বাদ পড়েনি। ঢাকা হলো সংকুচিত। যে ঢাকা ছিল একসময় ঘনবসতিপূর্ণ, তা হয়ে উঠল লোকশূন্য। ১৮৫৯ সালে তৈরি মানচিত্র অনুযায়ী, সে সময় ঢাকার দৈর্ঘ্যে সোয়া তিন মাইলের কিছুটা বেশি। প্রস্থে ছিল সোয়া এক মাইল প্রায়। অথচ শায়েস্তা খান তথা মোগল আমলে এর পরিধি ছিল ৪০ মাইল।
তবে ঔপনিবেশিক আমলে ইউরোপীয় ধাঁচে কিছুটা উন্নয়ন শুরু হয়েছিল। পাকা রাস্তা, উš§ুক্ত জায়গা, রাস্তার আলো, পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ প্রভৃতি সংযুক্ত হলো। ১৮২৫ সালে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডয়সের হাতে এসব উন্নয়ন হয়েছিল। ১৮৪০ সালে মিউনিসিপ্যাল কমিটি এবং ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠা হলো। ধীরে ধীরে উন্নয়নে বেগ পেতে থাকে, তবে এর আয়তন আর বাড়ল না। ডয়সে রমনা এলাকা পরিষ্কার করে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্থাপন করেন। আর্মেনীয় এরাতুন জমিদার পরিবার রেসকোর্স ময়দানের পশ্চিমে (বর্তমান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন এবং টিএসসি এলাকা) কিছু জায়গা কিনে একটি বাড়ি র্নিমাণ করে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকার নওয়াব পরিবার রেসকোর্স ময়দানের পশ্চিম পাশের এলাকার উন্নয়ন করেন। তারা বেশ বড় আকারের ভবন, কমপ্লেক্স এবং বাগান নির্মাণ করেন। তাই এলাকাটি শাহবাগ হিসেবে পরিচিত পেয়ে যায়। নওয়াবরা (খাজা আলীমুল্লাহর পরিবার) শুধু শাহবাগ নয়, শহরের উত্তর-পূর্ব অংশে দিলকুশা এবং মতিঝিল এলাকাও গড়ে তোলেন। ওইসব এলাকায় তারা বিনোদনের জন্য বাগানবাড়ি বানান।
ডয়সে নওয়াবপুরের উত্তর-পূর্ব অংশ পরিষ্কার করে এলাকাটিতে সেনাছাউনি স্থাপন করেন। এলাকাটিই পরবর্তীতে পুরানা পল্টন নামে পরিচিত হয়। অবশ্য এখানে ছিল মশার ব্যাপক প্রকোপ। তাই ১৮৫৩ সালে সেনাছাউনিটি লালবাগ দুর্গে স্থানান্তরিত করা হয়। শেষে ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের পর শহরের পূর্ব সীমানায় নদীতীরে মিল ব্যারাকে সেনাছাউনি আবারও স্থানান্তরিত হয়। পুরানা পল্টন এলাকা সিপাহিদের অনুশীলন ময়দান হিসেবে ব্যবহার হতো। আর কিছু অংশ কোম্পানির বাগান এবং খেলার মাঠে পরিণত হয়েছিল।
উনিশ শতকের শেষ এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতীরে ঢাকার উন্নয়ন ঘটতে থাকে। আহসান মঞ্জিল এবং রূপলাল হাউজের মতো বেশ কিছু জাঁকজমকপূর্ণ আলিশান ভবন নির্মাণ করেন। সি.ই বাকল্যান্ড নদীর উত্তর তীরে বাঁধ নির্মাণ করেন। ফলে এলাকাটি একটি চিত্তাকর্ষক এলাকায় পরিণত হয়। উনিশ শতকের আশির দশকে তিনটি পর্যায়ে এর নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা ওয়াটার ওয়ার্কস এবং সেন্ট টমাস চার্চ কমপ্লেক্সও এ সময় নির্মাণ হলো। রেলপথ নির্মাণের পর নদীতীর এলাকাটি গুরুত্ব হারায়।
উনিশ শতকের শেষে শহরের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। এর মধ্যে নারিন্দা ও গেণ্ডারিয়া উল্লেখযোগ্য। এ সময়েই হাজারীবাগ ও নওয়াবগঞ্জে উন্নয়ন ঘটে। হাজারীবাগে হাড় ও চামড়াশিল্প আর নওয়াবগঞ্জ পাট প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৮৬৬ সালে সেন্ট টমাস চার্চের পেছনে জেলা কোর্ট ও সাব-জজকোর্ট এবং ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কালেক্টর ফ্রেডারিক ওয়্যার উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ওয়ারীতে উন্নয়ন কাজ করেন। সুপ্রশস্ত রাস্তা এবং পয়োনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করেন। এমনকি একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেন।
১৮৮৫-৮৬ সালে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-ময়মনসিংহ স্টেট রেলওয়ে স্থাপিত হলো। মোগল আমলে স্থাপিত রাস্তার প্রায় সমান্তরালে স্থাপিত রেললাইনটি টঙ্গী থেকে তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত ধেয়ে চলল। তখন শাহবাগের বাগান এলাকাটি রক্ষার জন্য রেললাইনটি রমনার চারপাশে একটি লুপ তৈরি করে প্রথমে পূর্বে বাঁক নিয়ে নিমতলী-ফুলবাড়িয়ার মধ্য দিয়ে সামনে এঅেগায়, তারপর দক্ষিণে বাঁক নিয়ে ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জে পৌঁছায়। রেললাইনের অবস্থিতি লাইনের দক্ষিণ এবং পূর্বে মূল শহরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। ফুলবাড়িয়া এলাকাটি ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনসহ একটি রেলওয়ে কমপ্লেক্সের মতো গড়ে ওঠে।
এভাবে উনিশ শতক পর্যন্ত ঢাকার আবাসন, স্থাপত্য ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নকে বর্ণনা করা চলে। কার্যত ইংরেজরা মোগল অভিজাত রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে নিস্তরঙ্গে নিথর করে রাখল। যেন মোগল বা মুসলিম বিদ্রোহ এখনও কোনোভাবেই দানা বেঁধে উঠতে না পারে। আর পরবর্তী সময়ে যা কিছু উন্নয়ন সাধিত করেছিল, তা নিজেদের ব্যবসায় কাজের উন্নয়নে মাত্র। ফলে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের পাতায় ঢাকার কোম্পানি ও ব্রিটিশ আমলের স্মৃতি কেবল উচ্চ মহলের অংশটুকুই ধারণ করেছে। বাদ বাকি জনসাধারণের যাপিত জীবনের দিনলিপি গোচরীভূত হয়নি বা হওয়ার মতো চমৎকার কোনো উদাহরণ ছিল না। শোচনীয় জীবনের আলেখ্য ইতিহাস ধারণ করতে হয়তো সংকোচবোধ করেছে। অথচ নি¤œ, নি¤œ-মধ্য ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নিয়েই একটি নগরের সামগ্রিক আবাসন গড়ে ওঠে। আর এই শ্রেণি কাঠামোর মানুষরা একটি নগরের উন্নয়ন, সেই সঙ্গে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে নিরত বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিয়ে চলে। জনসাধারণকে শোষণ করে আধিপত্যবাদের উন্নয়ন ঘটে, তবে কোনো ভূ-খণ্ডের উন্নয়ন চিন্তাও করা যায় না। তাই ব্রিটিশ হটিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরেই সরকার জনসাধারণ নিয়ে ভাবতে শুরু করবে, সেটিই স্বাভাবিক। সেই সূত্রে পাকিস্তান সরকারের পাশাপাশি জহুরুল ইসলামও ঢাকার গৃহায়ন নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই সাধারণ শ্রেণি-কাঠামোকে লক্ষ্য করেই তিনি আবাসনশিল্প গড়ে তোলেন।
গবেষক, শেয়ার বিজ।