ঢাকার জীবনে নবচেতনা

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা।        পর্ব-১৪

মিজানুর রহমান শেলী: নবচেতনার নামে যে সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর যাত্রা শুরু হলো, এটা আবাসন থেকে শুরু করে ঢাকার যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রেষণা জোগাল। এটা বাংলা অঞ্চলের মানুষের চিন্তা ও কর্মে মুক্তির বাসনা জোগান দিয়েছিল। এই রেনেসাঁর ঢেউ উদ্ভব হয়েছিল ইউরোপ থেকে। ইউরোপে যখন ফরাসি বিপ্লব বা শিল্প বিপ্লব হয়ে গেল, তখন চারদিকে রোমান্টিসিজম ছড়িয়ে পড়ল। অবশ্য ঢাকায় এই নবচেতনার জোয়ার এসেছিল মূলত রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে। যার পেছনে ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি।

বাংলার এই নব্য যুগ চেতনাকে অনেকেই আধুনিকতা বলেন। তবে পশ্চিম যে আধুনিকতার মানদণ্ড, তা নয়। আধুনিকতার স্থিতি আর প্রখরতা আরও বেশি ব্যাপক ও গভীর। তবে মানতেই হয়, উনিশ শতকে বাংলার এই চেতনা জেগেছিল পশ্চিমের সভ্যতা আর সংস্কৃতির প্রতারণাপূর্ণ পরশে। যাহোক, আত্মসচেতনতা, রাজনৈতিক চেতনা, নতুন অর্থনৈতিক এবং সেই সূত্রে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, জীবনদৃষ্টির ভিন্নতা ইত্যাদি বাংলার কালপ্রাচীন সমাজব্যবস্থাকে নাড়া দিয়েছিল। ফলে ১৮২৯ সালে রামমোহনপন্থিদের পত্রিকা ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’ গৌড়দেশের শ্রীবৃদ্ধিকে ‘ডৌন অব অ্যা নিউ এরা’ (নবযুগের ভোর) বলে অভিহিত করে।

ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি ও রাজনৈতিক দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে বাংলার সচেতন মানুষের মনে যে নবজিজ্ঞাসার সূচনা হলো তার পীঠস্থান ছিল কলকাতা। এ.বি ছদ্মনামে এক ব্যক্তি ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ এক চিঠিতে লেখেন, আমোদ-প্রমোদ আর ফ্যাশনের অভিনবত্বে কলকাতা অল্পদিনের মধ্যেই ইউরোপের অধিকাংশ শহরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। জন কলিঞ্জ ধারণা করেছিলেন, উনিশ শতকের প্রথম দশকেই কলকাতা ইউরোপের ফ্লোরেন্স হবে। কার্যত এ সময়ে কলকাতা বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠল, বাড়ি ভাড়া ও জমির দাম বেড়ে গেল, জীবনের প্রয়োজনে নানা ভাষাভাষীরা এখানে ভিড় জমাল। ব্রিটিশ সরকার লটারির টাকায় কলকাতার উন্নয়ন শুরু করল। ১৮২৩-এ ‘কলকাতা কমলালয়’ বইতে কলকাতাকে মহানগর বলা হয়েছে। পরের বছর জেমস আটকিনসন একে প্রাসাদনগরী আখ্যা দেন। ১৮৩০ সালে ক্যালকাটা ম্যাগাজিনের এক প্রতিনিধি মন্তব্য করেন, অতীতের কবি ও অন্যান্যরা ট্রয়, করিন্থ বা রোম সম্পর্কে যা বলেছেন বা করেছেন তা আমাদের এই কলকাতার জন্য সত্য। পঞ্চাশ বছরের মাঝে আমাদের এই শহর কনস্টানটাইনের রাজধানীর মতো জগতের বিস্ময় আর মানুষের সৃষ্টিক্ষমতা ও ধৈর্যের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কলকাতার ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক পর্ব সম্পর্কে হেনরি এল্মসি বাস্টিড বলেন, আঠারো শতকের একেবারে শেষ অবধি ইংরেজরা কলকাতায় শুধু আফ্রিকান দাসই কেনাবেচা করেনি, বরং নিজেদের প্রয়োজনে দাসদের সন্তান বৃদ্ধির যাবতীয় ব্যবস্থা করতেন। দাস পালালে চাবুক পিটিয়ে মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হতো। সন্ধানে ক্যালকাটা গেজেটের পাতায় পাতায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। ঐতিহাসিক-অর্থনীতিবিদ মেডিসন ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পত্রিকা ‘দি ক্যালকাটা গ্যাজেট অ্যান্ড কমার্শিয়াল অ্যাডভার্টাইজরের বক্তব্য অনুসারে বলা যায়, ইংরেজরা কেবল অর্থের লোভে এবং ফিরে গিয়ে আরাম আর বিনোদনের জন্য এখানে এসেছিল। তাদের নৈতিক চরিত্রও ছিল নিচুতর। নারী আসক্তি, ঘোড়দৌড়, মদ্যপান আর জুয়া খেলা, অত্যাচার আর লুটতরাজই ছিল তাদের কাজ। ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ফিলিপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে ম্যাডাম গ্রান্ডকে নিয়ে প্রকাশ্যে ত্রিভুজ যুদ্ধে লড়াই করেছেন।

যাহোক, কলকাতায় তখন নানা ধরনের মানুষের ভিড়। সুযোগসন্ধানীরা দেওয়ানি বা মুচ্ছদগিরি কর্ম করে ভালো পয়সা কামিয়ে নিল। গ্রামগঞ্জে জমিদারি কিনল। শহরে বসে সে জমিদারির লাভের বখরা নিয়ে রঙ্গরসে দিন কাটাতে থাকে। তবে এই শ্রেণিভুক্তি লোকেদের মাঝে অনেকে কিন্তু প্রমোদে মাতোওয়ারা হয়ে গা ভাসিয়ে দেননি। বরং তাদের চিন্তাভাবনায় বাংলার নবচেতনা সম্পর্কিত প্রভূত জিজ্ঞাসা জাগরূক হতে থাকে। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন তখনকার প্রথম চিন্তক। আর তিনি ছিলেন একজন দেওয়ান। দ্বারকানাথ ঠাকুরও ছিলেন তার অন্তরঙ্গ। তিনিও সল্ট এজেন্ট মি. প্লাউডেনের দেওয়ান হিসেবে কাজ করেছিলেন দু’বছর। কিছু দিন আবগারি (লবণ ও আফিম) বিভাগে কাজ করেন। তাছাড়া তিনি ২৪ পরগোনা জেলার কালেক্টরের কাজ করেছেন। সে যুগের ‘কলকাতার রথচাইল্ড’ মতিলাল শীল ‘বিদেশাগত জাহাজসকলের মুচ্ছদগিরি কর্ম’ করতেন। রামমোহন-অনুরাগী প্রসন্নকুমার ঠাকুরও ছিলেন সল্ট এজেন্টের দেওয়ান। রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের প্রতিনিধি রামকমল সেন কলকাতা প্রিন্টিং প্রেসের কাজ ত্যাগ করে ড. উইলসনের আওতাধীন টাকশালের দেওয়ানি কাজে নিযুক্ত হন। ১৮৩২-এ তিনি বেঙ্গল ব্যাংকের দেওয়ান হিসেবে যোগ দেন। ‘ধর্মসভা’র একনিষ্ঠ সম্পাদক ভবানীচরণ বহু জায়গায় দেওয়ানের কাজ করেছেন।

এই সময়টা ছিল নবজিজ্ঞাসার প্রথম পর্ব। রামমোহন, দ্বারকানাথ বা প্রসন্নকুমারের মতো চিন্তকরা এই প্রথম পর্বে কেবল ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থে কাজ করেছেন। স্বপন বসুর মতে, তাদের দেশীয় ঐতিহ্য সচেতনতার পাশাপাশি পাশ্চাত্য শিক্ষা আর আধুনিকতায় ছিল এক দারুণ মোহ। ফলে তাদের জীবন ও আচার-আচরণে ছিল বিশ্বাস আর যুক্তির বিরোধ। তাই তারা এক নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত পৌঁছে নিজস্ব চিন্তায় ভাষা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে এ সময়ের সমাজ চিন্তায় কিছু পরিবর্তনের কথা বলেছেন স্বপন বসু। মানুষ তখন নিজের ওপর বিশ্বাস অর্জন করে। তাই দেবনির্ভরতা কিছুটা কমে আসে। মানবমুখী এই চেতনা তখন সাহিত্যেও আছড়ে পড়ে। তবে বৃহৎ অর্থে মানবিকতা যাকে বলে তা এ সময় অধরাই রয়ে যায়। জাত-পাত, শ্রেণি-মান ভুলে নিপীড়িত, বঞ্চিত মানবের প্রতি মমতা বা দায়বোধের প্রেরণায় কেউ সাধারণ দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। তাই নবজিজ্ঞাসা কেবল শহুরে শিক্ষিতের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। আদতে তখন দেবমুখিতা উচ্ছেদ হয়ে যায়নি। কোম্পানির লোকরাও ধর্ম নিয়ে তেমন বড় কোনো উচ্চবাচ্চ করেনি। দেবমুখিতার পাশাপাশি কেউ কেউ মানবমুখি হয়েছিলেন। রামমোহন ছিলেন বিষয়ী, ধর্মাচারী ও জীবনমুখী।

রামমোহন, রাধাকান্তা, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর ছিলেন একেক শ্রেণিবিশেষের প্রতিনিধি। তবুও তারা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ফুটিয়ে তোলেন নিজস্ব কাজকর্মে। এর প্রভাব পড়েছিল নারীমুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে। কেবল ভোগ্য বা সেবাদাসী নয়, স্বতন্ত্র ব্যক্তি মর্যাদা নিয়ে নারীকে সমাজ কাঠামোতে জায়গা দিতে তারা প্রয়াসী হয়েছেন। যদিও সে আন্দোলন কতটা সফল ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন নিরন্তর। বিস্তৃত আন্দোলন সত্ত্বেও বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহরোধ ও নারীশিক্ষা সমাজে সেকালে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এমনকি স্ত্রীশিক্ষা বৈধব্যের সূচকÑএই বিশ্বাস উনিশ শতকের বাঙালি হিন্দুর মানসিকতা থেকে উদ্গত হয়েছিল। তবে একটি আন্দোলন সে যুগে হয়েছিল, তার প্রভাব ঢাকায় এসে পড়ল।

কলকাতাকে সে সময় হিন্দু অধ্যুষিত ধরলে ঢাকাকে বলতে হতো মুসলিম অধ্যুষিত। তবে এই ঢাকাতেও ছিল হিন্দুদের বাস। ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থকরী কারবারে তারা নেতৃত্ব দিত। ঢাকায় নবচেতনা বলতে যা হলো, তা মূলত শিক্ষা কাঠামোকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিল। তাই দেখা গেল ঢাকা অঞ্চলের মানুষের মাঝে নিজেদের জীবনের সচেতনতা বেড়ে গেল। তারা দুর্বিষহ জীবন থেকে বেরিয়ে উন্নত জীবন চাইল। শিল্প-সাহিত্য এই চেতনার মূল ক্ষেত্র। তাই ঢাকার যাপিত জীবনে এলো পরিবর্তন। তবে হলফ করে বলা যায়, এই পরিবর্তনের হাওয়া প্রথম দিকে কেবল ঢাকার শিক্ষিত গোষ্ঠীর মানুষের যাপিত জীবনকে কিছুটা পরিবর্তন করতে পেরেছিল। ফলে তাদের আবাসন বিলাসে নবচেতনা ফুটে ওঠে। আর জনসাধারণের জীবনে এর প্রভাব পড়তে সময় লেগেছে আরও অনেক বেশি।

 

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০