নিজস্ব প্রতিবেদক: হালখাতা বাংলার একটি চিরায়ত ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্যকে স্মরণ, করদাতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি এবং বকেয়া রাজস্ব আহরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ‘জ্ঞানভিত্তিক আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ রাজস্ব-সংস্কৃতির বিকাশ’ সেøাগানে দ্বিতীয়বারের মতো সারা দেশে আয়কর ও ভ্যাট অফিসে আয়োজন করেছে ‘রাজস্ব হালখাতা ও বৈশাখ উৎসব’। করদাতারা এতে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন।
গতকাল রোববার সকাল ১০টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় কর অঞ্চল ৮-এর সম্মেলন কক্ষে রাজস্ব হালখাতা ও বৈশাখ উৎসবের উদ্বোধন করেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কর অঞ্চল ৮-এর কমিশনার সেলিম আফজাল। এছাড়া সকাল ১১টায় কর অঞ্চল ৪-এ রাজস্ব হালখাতা ও বৈশাখ উৎসবের উদ্বোধন করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক। পরে চেয়ারম্যান পর্যায়ক্রমে কর অঞ্চল-৩, ৫, ৬ ও ১২ পরিদর্শন, করদাতাদের সঙ্গে মতবিনিময় ও বকেয়া রাজস্ব গ্রহণ করেন। দুপুরে চেয়ারম্যান কর অঞ্চল ১২-এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে বসে কর প্রদানকারী দেশের বিখ্যাত শিল্পীদের মিলনমেলা।
কর অঞ্চল ৪-এর রাজস্ব হালখাতা ও বৈশাখ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, আয়কর নিয়ে মনের মধ্যে একটা ভয়-ভীতি ছিল। কিন্তু কর পরিশোধ করতে এসে দেখছিÑযতটা ভয় পেয়েছিলাম ততটা ভয় নয়, কর দেওয়া অনেক সহজ ব্যাপার।
কর অঞ্চল ৮-এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব হালখাতা এনবিআর ও করদাতাদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করছে। এ হালখাতার মাধ্যমে আমরা প্রকৃত করদাতাদের সম্মান করব, যারা স্বেচ্ছায় কর প্রদান করছেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সচেতনভাবে দেশে কর দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। কর দেওয়ার প্রথম দিকে অনেকের মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করলেও পরে তা আর থাকে না। আর এনবিআর এখন জনবান্ধব। করের আওতায় যারা এসেছেন তাদের সবাইকে কর দিতে হবে।
করদাতা ও কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সঠিকভাবে আয়কর প্রদান করলে ব্যবসার ক্ষতি হয় না, ব্যবসা বাড়ে। কোনো করদাতাকে হয়রানি বা উসকানি না দিতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো কর্মকর্তাকে হয়রানি করলে বা নিয়মের বাইরে কিছু দাবি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। করদাতাদের বলব, আপনারা সঠিকভাবে সাহসের সঙ্গে কর দিন। অন্যায্যভাবে এনবিআরের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী করদাতাদের যদি হয়রানি করতে চায় তার কঠোর শাস্তি হবে এবং তাকে কঠোর হাতে দমন করা হবে।
ট্যাক্স কার্ড বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, সিআইপিরা যেসব সুবিধা পায় কর বাহাদুর সম্মাননা ও ট্যাক্স কার্ডে সেসব সুবিধা নিশ্চিত করতে এনবিআর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছে। আগামীতে এসব সুবিধা নিশ্চিত করে ট্যাক্স কার্ড প্রদান করা হবে। কর প্রদান মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও ভ্যাট নিয়ে এখনও মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়নি। ব্যবসায়ীরা মানুষ থেকে ভ্যাট আদায় করলেও সঠিকভাবে সরকারি কোষাগারে জমা দেয় না। সঠিকভাবে ভ্যাট রাজস্ব কোষাগারে জমা প্রদান নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। সঠিকভাবে কর দিলে আল্লাহর কাছে মাফ পাবেন। ব্যবসারও উন্নতি হবে। এতে আমাদের ১৫ শতাংশ কর আহরণের যে টার্গেট রয়েছে সেটিও পূরণ হবে। বর্তমানে কর আহরণ হচ্ছে ৯-১০ শতাংশ হারে। যারা বেশি বেশি আয়কর ও মূসক দেন তাদের অত্যাচার করে নয়, বরং রাজস্ব আহরণের নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি। আগামী বাজেট ব্যবসাবান্ধব ও সুষম বাজেট হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
রাজস্ব হালখাতা ও বৈশাখ উৎসব উপলক্ষে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলাগাছ, কুলা, হাতপাখা, মুখোশ, খড়ের গেট আর রঙবেরঙের দেয়াল কার্টুনে সাজানো হয় কর অঞ্চল, ভ্যাট কমিশনারেট ও ভ্যাট অফিস। এছাড়া বৃহৎ করদাতা ইউনিট (আয়কর ও মূসক) নতুন রূপে সাজানো হয়। খোলা হয় হালখানার ঐহিত্যবাহী নতুন রেজিস্টার খাতা। মাটির সানকিতে দেওয়া হয়েছে মিষ্টি, বাতাসা, নারিকেলের নাড়–, সন্দেশ, খৈ, কদমা, মুরালি, নিমকি, মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া, তিলের খাজা, সুন্দরী পাকনপিঠা, শাহী পাকনপিঠা, নকশিপিঠা, ঝিনুকপিঠা, স্পঞ্জ রসগোল্লা, দই, ডাবের পানি, তরমুজ, পেয়ারা, বরইসহ অন্যান্য ফল। আয়োজন করা হয় জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। প্রতিটি কর অঞ্চল ও ভ্যাট অফিসে করদাতারা উৎসবমুখর পরিবেশে রাজস্ব পরিশোধ করেন। বকেয়া কর প্রদানের পর করদাতাদের উপহার হিসেবে বই দেওয়া হয়।
কর অঞ্চল-১, ৩, ৮, ১০, ১২, ১৪, এলটিইউ (কর ও মূসক) ও ভ্যাট কমিশনারেট ঘুরে দেখা যায়, গ্রামবাংলার সব ঐতিহ্য তুলে ধরার মাধ্যমে সাজানো হয়েছে কর ও ভ্যাট অফিস। করদাতারা সুশৃঙ্খলভাবে কর প্রদান করছেন। করদাতাদের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার আয়োজনে অ্যাপায়ন করা হচ্ছে। পৃথকভাবে প্রতিটি কর অঞ্চল ও ভ্যাট অফিসে বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করেছেন করদাতারা। গতবছর রাজস্ব হালখাতায় ৫৬৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছিল।