‘মানুষকে বোঝা না ভেবে সম্পদ মনে করতে হবে’

শিল্পোদ্যোক্তা কাজী জামাল উদ্দিন প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘কাজী লেদার প্রোডাক্টস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’। ২০০০ সালে স্বল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করেন এ ব্যবসা। তার কারখানায় তৈরি হয় চামড়ার ব্যাগ, মানিব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, ট্যুর ব্যাগ, বেল্ট, অফিসিয়াল ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, রেইনকোট, ছাতাসহ আরও অনেক পণ্য। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও হয় এসব। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ৫৪ শ্রমিক, যাদের বেশিরভাগই প্রতিবন্ধী। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ফেনী পিটিআই মাঠে অনুষ্ঠিত ‘এসএমই পণ্যমেলায়’ গ্রামীণ শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে তিনি প্রথম হয়েছেন। সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় তার ক্যারিয়ার ও ব্যবসাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছেন শেয়ার বিজের ফেনী প্রতিনিধি শাহাদাত হোসেন তৌহিদ

আপনার ব্যবসা শুরুর গল্পটা শুনতে চাই…

জামাল উদ্দিন: শুরুতে আমি বাড়ির ড্রয়িং রুমে একটি মেশিন দিয়ে কাজ শুরু করি। যদিও এর আগে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ালেখার পাশাপাশি একটি পেপার কাটিংয়ের ব্যবসা আরম্ভ করেছিলাম। তখন বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারিনি। ২০০০ সালে আমরা পারিবারিকভাবে পৃথক হওয়ার পর ব্যবসা নিয়ে আবারও চিন্তা শুরু করি। প্রথমে আমার গ্রামের বিধবা দুই নারী সিনু রানী ও মিনু রানীকে আমার কারখানায় কাজ দিই। তারা এখনও কাজ করছেন। ধীরে ধীরে ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে বাড়ির পাশে একটি জায়গা নিয়ে ছোটখাটোভাবে কারখানা দিয়ে কাজ শুরু করি। জায়গাটির পাশে গাছ লাগিয়ে বাগানবাড়ির মতো করে সাজাই, যেন পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়। এভাবে আমি কাজ শুরু করি। তখন অবশ্য অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই। তবে সব বাধা অতিক্রম করি। মাঝখানে আট শতাংশ জায়গার মধ্যে কারখানা করি।

কারখানায় কাজের ক্ষেত্রে কাদের প্রাধান্য দেন?

জামাল উদ্দিন: ছোটকালে বাবা মারা যাওয়ার পর অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। ফলে গরিব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আমি বুঝি। এ কারণে আমার সংকল্প ছিল গ্রামের পতিত জায়গায় ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান করার, যেখানে শারীরিক প্রতিবন্ধী, একাডেমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, অসহায়, স্বামী পরিত্যক্ত নারীদের কর্মসংস্থান হবে। আমার কারখানায় এখন ঝরে পড়া নারী-পুরুষ ও প্রতিবন্ধীরা কাজ করেন। অনেক লোক এখান থেকে কাজ শিখে বিদেশে কর্মসংস্থান করেছেন। তারা সবাই আজ প্রতিষ্ঠিত।

আপনার কারখানায় কী কী তৈরি হয়?

জামাল উদ্দিন: খাঁটি চামড়ার ব্যাগ, ছাতা ব্যাগ, ট্যুর ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, ছাতা, বেল্ট, লাগেজ, অফিসিয়াল ব্যাগ, সুটকেস, চেইন ব্যাগ, রেইনকোট প্রভৃতি তৈরি করা হয়। এগুলো তৈরি করে শ্রমিকরা নিজেদের ভরণ-পোষন চালাতে পারছেন। কারখানায় পাইকারি ও খুচরাও বিক্রি করা হয়।

প্রথম পুঁজিটা কোথায় পেয়েছিলেন?

জামাল উদ্দিন: প্রথম পুঁজিটা আমি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশা থেকে নিয়েছিলাম। সে সঙ্গে আমার জমানো কিছু টাকাও ছিল।

কোনো স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন কী?

জামাল উদ্দিন: আমাদের দেশের মানবসম্পদকে আমরা বোঝা মনে করি। আমি তা মনে করি না। তাদের ঘিরেই কয়েকটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। আজও দেখছি যেমন শারীরিক প্রতিবন্ধীদের হাতে তৈরি পণ্য দেশে ও বিদেশে সরবরাহ করা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বল্প পুঁজির টেকসই কারিগরি প্রতিষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। মানবসম্পদ তৈরিকল্পে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিতদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মে সম্পৃক্ত করা। এ ছাড়া অদক্ষ শ্রমিকদের দক্ষ করে তোলা, প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, সব শ্রমিককে স্বনির্ভর করে তোলা, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা, গ্রামভিত্তিক শিল্পসমাজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা, গ্রামবিমুখ জনগোষ্ঠীকে গ্রামমুখী করা, গ্রাম উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করা, গ্রামীণ পতিত জমির সর্বোত্তম ব্যবহারসহ অনেক বিষয়ই আমার স্বপ্ন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেকটা এগিয়ে গেছি। এভাবেই আমি আমার ক্ষুদ্র শিল্পকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই।

কোন কোন দেশে আপনার তৈরি পণ্যগুলো যাচ্ছে?

জামাল উদ্দিন: যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, দুবাই, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রফতানি করি। কেউ ব্যক্তিগতভাবে, কেউবা চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়ে আমার পণ্য সরবরাহ করছে।

কারখানা পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন?
জামাল উদ্দিন: কারখানার ক্ষেত্রে মানুষ, মেশিন, ম্যাটেরিয়াল এ তিনটিই অপরিহার্যভাবে লাগে। পরে গুণগত মান। এগুলো মাথায় রাখতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা কাজ করি।

উপার্জিত টাকা কোনো মানবিক কাজে খরচ করেন কী?

জামাল উদ্দিন: আমার কারখানা থেকে উপার্জিত টাকা নিজের কাজের পাশাপাশি দরিদ্র মানুষকে দান করি। ফেনী শহরের রেলওয়ে স্টেশন ঘিরে থাকা শিশুকল্যাণ সম্পর্কিত ‘কাজী জামাল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করি আমি।

যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের জন্য পরামর্শটা কেমন হবে?

জামাল উদ্দিন: মনে রাখতে হবে, মানুষকে কখনও বোঝা হিসেবে নেওয়া যাবে না। তাদের সম্পদ মনে করতে হবে। পাশাপাশি সততা, পরিশ্রম, নিষ্ঠা, মানবসেবার ইচ্ছা থাকতে হবে। না হয় সফলতা আসবে না। সব মানুষের সহযোগিতা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসার চেয়ে গুণগত মানকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে। ফলে একদিন না একদিন সফলতা ধরা দেবেই।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০