বর্তমান ব্যাংক ব্যবস্থা বিকলাঙ্গ ও এতিম

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা বর্তমানে বিকলাঙ্গ ও এতিমে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংগঠনটি জানায়, ২০১৭ সাল ছিল ব্যাংক খাতে কেলেঙ্কারির বছর। আর এখন এটি একটি বিকলাঙ্গ ও এতিম খাতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া দেশে এখন যে কর্মসংস্থান হচ্ছে, সেটা আয়হীন কর্মসংস্থান।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল ‘জাতীয় বাজেট ২০১৮-১৯: সিপিডির সুপারিশমালা’ শীর্ষক বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বাধীন পর্যালোচনাবিষয়ক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ কথা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে দেশের অর্থনীতি ও বাজেট সুপারিশ নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির রিচার্জ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, ডায়ালগ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফসহ অন্যান্য সহযোগী গবেষক উপস্থিত ছিলেন।

ব্যাংক খাতের অবস্থা নিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত বছরের শুরুতে আমরা বলেছিলাম ২০১৭ সাল হবে ব্যাংক খাতে কেলেঙ্কারির বছর, হয়েছেও তাই। আর এবার ২০১৮ সাল ব্যাংক খাতকে এতিম করার বছর। এ খাতকে যাদের রক্ষা করার কথা ছিল, তারাই চাপের মুখে ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার সংরক্ষণমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সিআরআর কমিয়ে দিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করল। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের ঘোষিত নীতিই ভঙ্গ করল। তিনি বলেন, ‘তারল্য ঘাটতির কথা বলে সিআরআর কমানো হচ্ছে। তারল্য ঘাটতি তো হলো একটা রোগের উপসর্গ। এটা তো রোগ নয়। রোগ হচ্ছে আপনি (সরকার) একটা বিকলাঙ্গ ব্যাংক ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছেন।’

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘মূলধনি যন্ত্রাংশ আমদানি বাড়ছে। সরকারি বিনিয়োগও বেড়েছে। তবে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির তুলনায় তিন বছর ধরে একই জায়গায় আটকে আছে। অন্যদিকে মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও তা ছাপিয়ে সাড়ে ১৮ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। তাহলে এ ঋণের টাকা যাচ্ছে কোথায়?’ ফলে অর্থ পাচার হচ্ছে হলে আশঙ্কা করছে সিপিডি।

দেশে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বাজারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। এখানে নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু ব্যাংককে একীভূত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে বাজারে একটা স্থিতিশীল প্রতিযোগিতা নিয়ে আসা দরকার।

এর আগে মূল প্রবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ২০১৭ সালে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ব্যাসেল-৩ পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে। একই সময় মোট ঋণের ২০ শতাংশ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো মুনাফা করলেও সুদহার অনেক বেড়েছে। এটি আর্থিক ব্যবস্থার জন্য ভালো সমাধান নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর জন্য এক ধরনের মুদ্রানীতি ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে সিআরআরের ক্ষেত্রে নতুন প্রজ্ঞাপন এ খাতে তাদের দুর্বল নীতির ভিত্তির প্রমাণ দিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের হার ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত ভালো হলেও এটি  ঢালাওভাবে করা উচিত নয়। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কয়েক বছরের পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করেই তাদের সরকারি আমানত গ্রহণের হার নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

ব্যাংকে পুনঃমূলধন জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি আরও বলেন, জনগণের করের টাকায় প্রতিবছর ব্যাংকে মূলধন জোগান দেওয়া নীতিগতভাবে উচিত নয়। প্রতিবছর বাজেটে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, আর ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপি হওয়ার মাধ্যমে তা খেয়ে ফেলে। এটা বন্ধ করতে হবে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ নিয়ে সিপিডি জানিয়েছে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বেড়েছে। তবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়েনি। একই সঙ্গে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। ফলে একটি আয়হীন কর্মসংস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চতর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও কর্মসংস্থান আরও গুরুত্বপূর্ণ। আগে ছিল কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, এখন হয়ে গেছে আয়হীন কর্মসংস্থান।

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত নারীদের মাসিক আয় আগের বছরের তুলনায় গড়ে তিন দশমিক আট শতাংশ এবং গ্রামের মানুষের আয় চার শতাংশ কমেছে বলে উল্লেখ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান কিছুটা বাড়লেও খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে কমেছে।

রাজস্ব চিত্র পর্যালোচনা করে সিপিডি জানায়, উচ্চ লক্ষ্যমাত্রার বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্বে বড় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। আগের বছরও একই কাজ করার কারণে বছর শেষে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থেকেছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত যে প্রাক্কলন, তাতে ঘাটতির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এবারও বাজেটে অনেক বড় সংশোধন আনতে হবে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ব্যবসাবান্ধব রাজস্বনীতি করতে হবে। তবে হঠাৎ করেই করপোরেট কর কমানো উচিত হবে না। করপোরেট কর কমানোর ক্ষেত্রে এর বাস্তব প্রতিফলন বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি নতুন নতুন রফতানি খাতে বন্ড সুবিধা দিতে হবে। বন্ডের অপব্যবহার রোধে কার্যকর উদ্যোগও নিতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০