ইসলামী ব্যাংকে অস্থিরতা

নিজস্ব প্রতিবেদক: শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে ইসলামী ব্যাংকের সুনাম বিশ্বব্যাপী। গত তিন দশক ব্যাংকটি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। লাখো উদ্যোক্তা তৈরিতে অবদান রেখেছে। কিন্তু অল্প সময়ে তা নষ্ট হতে চলেছে। ব্যাংকটিতে চলছে এখন চরম অস্থিরতা। মানসম্মান ও জেলের ভয়ে একে একে বিদায় নিচ্ছেন ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। ফলে ব্যাংকটি ইমেজ সংকটে পড়েছে। পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তার সংকটে পড়তে যাচ্ছে ব্যাংকটি। গত ১৬ মাসে পদত্যাগ করেছেন দুই চেয়ারম্যান, তিন এমডি, তিন ডিএমডিসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা।
ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় চেয়ারম্যান আরাস্তু খান ও ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম পদত্যাগ করেছেন। সভায় নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যাংকটির স্বতন্ত্র পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমুল হাসানের নাম প্রস্তাব করা হয়। আরাস্তু খানকে মনোনয়ন করা আরমাডা স্পিনিং মিলের পক্ষে নতুন করে পরিচালক হয়েছেন তিনি।
এদিকে মাত্র ১৬ মাসে ব্যাংকটিতে চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়। গত বছরের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ারকে সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভাতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন আরাস্তু খান। কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে আসেন তিনি। এ সময় তৎকালীন এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে সরিয়ে দিয়ে নতুন এমডি করা হয়েছিল আবদুল হামিদ মিঞাকে। তবে বয়সের কোটা পূর্ণ হওয়ায় পুনরায় নতুন এমডি করা হয় ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব উল আলমকে। তবে অচিরেই বর্তমান এই এমডিও পদত্যাগ হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরাস্তু খান শেয়ার বিজকে বলেন, ইসলামী ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ব্যাংক। এখানে অনেক ধরনের কাজ রয়েছে। প্রতিদিন অনেক ফোন আসে। আমি আর কাজের চাপ সামলাতে পারছি না। তাই পদত্যাগ করেছি।
গত ৫ এপ্রিল ইসলামী ব্যাংকের (ম্যানেজমেন্ট) ব্যবস্থাপনা থেকে তিন ডিএমডিসহ শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তা বিদায় নেন। অপসারণ করা কর্মকর্তারা হলেনÑঅতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মো. শামসুজ্জামান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া এফসিএ, ডিএমডি আবদুস সাদেক ভূঁইয়া, ডিএমডি মোহাম্মদ মোহন মিয়া ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) আমিরুল ইসলাম।
জানা গেছে, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে বেশ তাল মিলিয়েই চলছিলেন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে বেশ কর্মতৎপর ছিলেন তিনি। এস আলম গ্রুপ কর্তৃক এসআইবিএল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সময় তার ভূমিকা ছিল বেশ আলোচিত। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকটিকে নতুন উদ্যমে পরিচালনা করতে নানা ধরনের উদ্যোগও নিয়েছেন আরাস্তু খান। তবে হঠাৎ করেই গতকালের বোর্ড সভায় তিনি পদত্যাগ করেছেন তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে আরাস্তু খানকে ইসলামী ব্যাংক থেকে সরানো হচ্ছে, তা গত প্রায় এক মাস থেকেই পরিচালকদের মধ্যে আলোচনা চলছিল বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। সর্বশেষ গত ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছিলেন আরাস্তু খান। সেখান থেকে তাকে মলিন মুখে বের হতে দেখা গিয়েছিল।
আরাস্তু খানের পদত্যাগের বিষয়ে ব্যাংকটির পদত্যাগকারী সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আরাস্তু খান ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই গোঁজামিল দিয়ে চালাচ্ছিলেন। ব্যাংকের মুনাফায় ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছেন। ব্যাংক বাঁচাতে তাকে সরানোর প্রয়োজন ছিল। সঠিক সময়ে তাকে সরিয়ে দেওয়ায় সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।’
এদিকে নিত্য পদত্যাগ ও অপসারণে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংকটির শীর্ষ ম্যানেজমেন্টে ১১ জন কর্মকর্তার মধ্যে পাঁচজনই পদত্যাগ করেছেন। এখন আছেন ছয় কর্মকর্তা। পদত্যাগ নিয়ে ইসলামী ব্যাংকে রয়েছে নানা ধরনের অভিমত। একটি সূত্র জানিয়েছে, বোর্ড চাপ সৃষ্টি করে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এসইভিপি ছাড়া বাকি সবার চুক্তির মেয়াদ ছিল এক বছর। গত বছরের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তনের যে ধারা শুরু হয়েছিল এটি তারই ধারাবাহিকতা।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, কয়েকজন কর্মকর্তা বোর্ডের সঙ্গে ভিন্নমতের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। মূলত মানসম্মান রক্ষার্থে ও জেলে যাওয়ার ভয়ে তারা স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদত্যাগী এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান বোর্ডের কথামতো চললে ভবিষ্যতে দুদক, জেল, জরিমানা অবধারিত। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এতে সাময়িক সমস্যা হলেও পেশার মর্যাদা রক্ষা হলো। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ আইন-আদালত ও দুদকের ঝামেলা থাকল না।
ধারাবাহিকভাবে পদত্যাগের বিষয়ে আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একটি ভালো প্রচলন শুরু হয়েছে। ব্যাংকাররা এখন আর বোর্ডের কথা অনুযায়ী চলছেন না। পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা না মেনে তারা এখন পদত্যাগ করছেন। এটি শুরু হয়েছে আসলে ব্যাংকারদের বিচারের আওতায় আনার পর। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ব্যাংকে দেখা গেছে, আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। দুদক, আদালত এবং জেলের ভয়ে এখন অনেকেই পরিচালনা পর্ষদের কথা শুনতে চাচ্ছেন না। তাই তারা পদত্যাগ করছেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০