জহুরুল ইসলামের চাকরিতে ইস্তফা

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-২৩

 

মিজানুর রহমান শেলী: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কশাঘাত থেকে মুক্তি লাভের পর ঢাকা ক্রমোন্নতিশীল ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। এর ফলে ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন চলাচলে সমস্যাও সৃষ্টি হয়। এই বেড়ে ওঠা যানবাহন সমস্যার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠার জন্য ঢাকায় ক্রমবর্ধমান প্রান্তিক সুবিধাদি প্রদানের প্রতি রেল প্রশাসন ছিল সব সময় সজাগ। বর্তমান রেলওয়ে স্টেশনটি কমলাপুরে স্থানান্তরিত করার জন্য এবং নগরীর উত্তর প্রান্তসীমা বরাবর এটিকে তেজগাঁও থেকে গেণ্ডারিয়া পর্যন্ত একটি বিকল্প লাইন দ্বারা সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সালে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বাস চলাচল শুরু হয়। ঢাকা তখন প্রাদেশিক রাজধানী হওয়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজন হয়। তাই সারা দেশে রাস্তা, সেতু ইত্যাদি যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নয়নে ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এ কাজটি স্বল্প সময়ের মধ্যে সরকারের সিঅ্যান্ডবি বিভাগ সম্পন্ন করেন।
উল্লেখ্য, এ সময়েই জহুরুল ইসলাম সিঅ্যান্ডবিতে একজন ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছিলেন।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পরে ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি চলাচল শুরু হয়। ঢাকা মোটরগাড়ি সমিতির এ সময় ১৪০টি বাস ছিল। ৮০টি বাস মহানগরীর ভেতরে প্রতিদিন চলাচল করত। ইপিআরটিসি নামে সরকারি বাসও ছিল। সরকারি-বেসরকারি বাসের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত।
ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা থেকে সাভার, ঢাকা থেকে টঙ্গী, ঢাকা থেকে ডেমরা, ঢাকা থেকে নরসিংদী, ঢাকা থেকে রোহিতপুর, ঢাকা থেকে সাভার হয়ে নয়ারহাট ও ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে আদমজী রুটে বাসগুলো নিয়মিত চলাচল করত।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠন হওয়ার পরেই প্রথম বেসামরিক বিমান চালু হলো। ইস্পাহানি গ্রুপের ওরিয়েন্ট এয়ারলাইনস প্রথম এটা চালু করে। এ এয়ারলাইনস খুব বেশি সফলতা দেখাতে পারেনি। তাই পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস করপোরেশন এ দায়িত্ব পায়। কলকাতা, চট্টগ্রাম, করাচি, ঢাকা ও লাহোর রুটে বিমান চলাচল করত।
যাহোক, ১৯৪৭-এর পর রেডিওতে উন্নয়ন সাধিত হলো। ঢাকা বেতার কেন্দ্রে সাত দশমিক পাঁচ কিলোওয়াটের শর্টওয়েভ প্রচার যন্ত্র স্থাপন করা হয়।
১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পরে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পেলে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বিভাগে এবং এর ব্যবস্থাপনায় চমকপ্রদ উন্নয়ন সাধিত হয়। ডিএইচএফ নামক অতি উচ্চ মানের স্পন্দন দৃঢ়তা সম্পন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা বসানো হয়। ফলে ঢাকা ট্রাঙ্ক টেলিফোনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর আরও অনেক উন্নত শহরের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে শুরু করল। পিলখানা ও সেনানিবাসেও ডিএইচএফ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
যোগাযোগের মতো সবকিছুতেই তখন উন্নয়ন অনিবার্য হয়ে ওটে। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রগতির ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বহু গুণে বেড়ে যায়। তাই ৪০ হাজার কিলোওয়াট সম্পন্ন একটি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয় সিদ্ধিরগঞ্জে।
কার্যত, পাকিস্তান সৃষ্টির পর জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরোনো থেকে নতুন পদ্ধতি উত্তরণের একটি জোয়ার লক্ষ্য করা গেল। চট্টগ্রাম বন্দর একটি অবহেলিত গুরুত্বহীন অবস্থায় পড়েছিল। দেশ বিভাগের পরে তা আবার কলকাতার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানের একটি বড় ব্যবসায় কেন্দ্রে পরিণত হয়। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী সব রেল ও স্টিমার পথ গুরুত্ব হারালো। পাকিস্তান সরকার চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়ন ঘটাল। নতুন নতুন পথ তৈরি করা হয়।
বস্তুত, দেশের সব দিক দিয়েই যেন ব্রিটিশ আমলের চেয়ে উন্নয়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। জš§-মৃত্যুর পরিসংখ্যান ঘাঁটলেও বোঝা যায়, মৃত্যুহারের চেয়ে জš§হার দিনে দিনে বেড়ে চলেছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত মৃত্যু সংখ্যার চেয়ে জš§ সংখ্যা প্রতিবছরেই বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত প্রতি এক হাজার লোকের জš§হারের সঙ্গে মৃত্যুহার তুলনা করে দেখা গেছে, মৃত্যুহারের ওপর জš§হার প্রতি হাজার লোকের ছয় দশমিক ৯ জন বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৪৭ সালের পরে হঠাৎ করেই এমন জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি রমনা এলাকার উত্তর, উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিমের সব উঁচু ভূমিতে নতুন ঢাকা গড়ে ওঠতে থাকে। মোগল আমলের পুরোনো ঢাকা উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে নওয়াব পরিবার দ্বারা লালিত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর নতুন জীবনের স্পন্দনে জেগে ওঠে।
শিক্ষা খাতেও দেখা গেল একই উন্নয়ন দশা। ১৯৬১ সালের আদমশুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা জেলার বিভিন্ন মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সংখ্যা উঠে আসে। :
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্তর মোট পুরুষ মহিলা
পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ২,০৪৩ ১,৮৮৬ ১৫৭
গ্র্যাজুয়েট ৭,৪০৪ ৬,৯৩৭ ৪৬৭
আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ১৩,২৬৭ ১২,২৮৪ ১,০১৯
ম্যাট্রিকুলেশন ৩৬,৯২৭ ৩৩,৯৮০ ২,৯৪৯
পঞ্চম শ্রেণি পাস ৭১,২৯১ ৫২,২৯০ ১৯,০০১
চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া ১,০৪,৬৪০ ৭০,৪১৫ ৩১,২২৫
চারদিকে বইছিল এমন আনন্দ আর স্বপ্নের সুবাতাস। তার বাস্তবায়নের প্রাথমিক সফলতাও ছিল আশাসঞ্চারী। জহুরুল ইসলাম তখন আর চাকুরে জীবনের ধরাবাধা মাইনে জীবনে বসে থাকতে পারলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন এবং ব্যবসা শুরু করবেন।
আড়াই বছরের এই চাকরি জীবনে তিনি সুনাম কুড়িয়েছিলেন। এ সময় সাল ১৯৫১। পদত্যাগের কথা শুনে অফিসার তার উচ্চপদে উন্নীতকরণসহ লোভনীয় প্রস্তাব দেন। জহুরুল ইসলাম তা গ্রহণ করলেন না। বিনয়ের সঙ্গে চাকরি ছেড়ে দিলেন।
এভাবেই জহুরুল ইসলাম তার চাকরি জীবনের আড়াইটি বছরে সিঅ্যান্ডবির আওতাধীন বিভিন্ন উন্নয়নকাজ কাছে থেকে দেখেছিলেন। ফলে এসব পরিচালনার ব্যাপারে তার একটি আত্মবিশ্বাস জšে§ছিল। কীভাবে কোন কাজ করতে হবে। ঠিকাদারি পাওয়া, পরিচালনা এবং অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের মাঝে সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়া তিনি ভালোভাবে রপ্ত করেন। এটাই ছিল তার ঠিকাদারি ব্যবসার হাতেখড়ি।
গবেষক, শেয়ার বিজ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০