শেখ আবু তালেব: এনবিআরের মামলার জেরে দীর্ঘ প্রায় ১৬ মাস ধরে বন্ধ খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (কেপিপিএল)। উৎপাদনে না থাকলেও পুঞ্জীভূত ঋণের সুদের কারণে কোম্পানিটির দায় বাড়ছে। কর ফাঁকি, জরিমানা, কাস্টমসের পাওনা, ব্যাংকঋণের কিস্তি ও অন্য খরচ মিলিয়ে কোম্পানিটির দায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বন্ধ কেপিপিএলের তালা খুলতে হলে ওই পাওনা পরিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে পাওনা নিয়ে এনবিআর-কেপিপিএলের মধ্যে চলমান দুটি মামলার ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য। তাই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্লাস্টিকের প্যাকেজিং পণ্য উৎপাদন ও লেবেল প্রিন্টিং এবং সরবরাহকারী কোম্পানি খুলনার লকপুর গ্রুপের কেপিপিএল। ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে কোম্পানিটি। রফতানিমুখী পণ্যের মোড়কের জন্য প্লাস্টিকের লেবেল, প্লাস্টিক ও কাগজের মোড়ক তৈরি, সব আকারের কার্টন বক্স তৈরি, খাদ্য, মাছ বিশেষত সামুদ্রিক মাছ প্যাকেট করার জন্য সব আকারের কার্টন তৈরি করে কোম্পানিটি। মূলত গ্রুপের অন্য কোম্পানির চাহিদা পূরণের জন্যই কাজ করত কেপিপিএল। স্থানীয় বাজারেও কিছু পণ্য বিক্রি করে কোম্পানিটি।
তালিকাভুক্তির পর ২০১৫ সালে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্রায় ২৭১ কোটি ৭২ লাখ টাকা কর ফাঁকি ও বন্ড সুবিধা নিয়ে উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে বেশি কাঁচামাল আমদানির অভিযোগ আনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর না দেওয়ায় কোম্পানির সব ওয়্যারহাউজ সিলগালা ও বন্ড লাইসেন্স বাতিল করে এনবিআর। এতে কোম্পানিটির প্রায় ৫৩ কোটি টাকার কাঁচামাল আটকে যায়।
অন্যদিকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষও প্রায় ৫৪ কোটি টাকার আমদানি পণ্য আটকে দেয়। এনবিআরের অবস্থানের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে পণ্য ছাড় ও ওয়্যারহাউজ খুলে দেওয়ার আদেশ নিয়ে আসে কেপিপিএল। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে পরবর্তী সময়ে রায় পায় এনবিআর। এসব অভিযোগে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রায় একডজন মামলা করেছে এনবিআর। এর মধ্যে দুটি এখনও চলমান রয়েছে। কাঁচামাল সংকট, উৎপাদন কমে যাওয়া ও মামলার কারণে ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি উৎপাদন বন্ধ করে কেপিপিএল কর্তৃপক্ষ। প্রায় ১৬ মাস উৎপাদন বন্ধ থাকায় মেশিনপত্র অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
এনবিআরের হিসাবে, সংকট সমাধান করতে হলে কেপিপিএলকে ফাঁকি দেওয়া প্রায় ২৭১ কোটি ৭২ লাখ টাকা করের সঙ্গে জরিমানা হিসেবে আরও ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। এ হিসেবে কেপিপিএলের কাছে প্রায় ৩৭১ কোটি ৭২ লাখ টাকা পাবে এনবিআর। অন্যদিকে বর্তমানে প্রায় ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যাংকঋণ রয়েছে কেপিপিএলের। এছাড়া অন্য দায় মিলিয়ে কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত দায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এসব দায় পরিশোধ না হলে কোম্পানির উৎপাদন চালুর সুযোগ নেই।
কেপিপিএলের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেছেন, ‘এনবিআরের দাবি করা অর্থ ও মামলার কোনো ভিত্তি নেই। আমরা বাকি মামলায়ও জিতব। কারখানা বন্ধ থাকলেও কর্মচারীর পেছনে ব্যয় ও ঋণের কিস্তি গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে। মামলা শেষ হলে কারখানা চালু করা হবে।’
২০১৪ সালে তালিকাভুক্তির পর কোম্পানির কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল প্রায় ৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, যা পরের বছরে বেড়ে ১০ কোটি ২৩ লাখে দাঁড়ায়। এক বছরের ব্যবধানে এ মুনাফা প্রায় আট কোটি টাকা কমে ২০১৬ সালে প্রায় দুই কোটি ৩৭ লাখ টাকায় নেমে আসে। আর উৎপাদন বন্ধের কারণে ২০১৭ সালে প্রায় আট কোটি ৯৪ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে কেপিপিএল।
ব্যবসায়িক মন্দা ও লোকসানের কারণে গত দুই বছরে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে থাকা কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে চার দশমিক ২৬ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৫৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গত দুই বছর ধরে কোম্পানিটির শেয়ারদর অভিহিত মূল্যের কাছাকাছি অবস্থান করছে। গত ফেব্রুয়ারিতে গুজবের কারণে শেয়ারদর কিছুটা বাড়লেও গতকাল তা আবারও ১২ টাকার নিচে নেমেছে।