রহমত রহমান: দেশের অভ্যন্তরে ভারী শিল্প স্থাপনে সরকার উৎসাহ প্রদান করছে, কিন্তু ভারী শিল্প হিসেবে খ্যাত দেশীয় গাড়ি তৈরি ও বাজারজাত করায় উৎসাহ প্রদান করছে না বলে অভিযোগ এ খাত-সংশ্লিষ্টদের। শুল্ককর আর স্থানীয় গাড়ি উৎপাদনে মূসকের কারণে এ খাতের বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। উদ্যোক্তাদের দাবি রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশন, মোটরসাইকেলের মতো বিনিয়োগঘন ভারী শিল্প স্থাপনে শুল্ককর সুবিধা দেওয়ার ফলে এসব খাত বর্তমানে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশীয় গাড়ি উৎপাদন শিল্পকে এভাবে মূসক ও শুল্ককর সুবিধা দেওয়া হলে এ খাত অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারবে। দেশে প্রথমবারের মতো গাড়ি উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করেছে পিএইচপি গ্রুপ। স্থানীয় গাড়ি উৎপাদনে ভ্যাট ও শুল্ককর প্রত্যাহারে এনবিআর চেয়ারম্যানকে সম্প্রতি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সই করা চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরে ভারী শিল্প স্থাপনে প্রণোদনা হিসেবে শুল্ককর ছাড় দিচ্ছে সরকার। ফলে দেশে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশন ও মোটরসাইকেলের মতো ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ খাতে আমদানি-নির্ভরতা কমে গেছে। সম্প্রতি কয়েকটি কোম্পানি এসব পণ্য রফতানি শুরু করেছে। ‘জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬’-তে অটোমোবাইল শিল্পকে অগ্রাধিকারভিত্তিক শিল্প হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলেও এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে কোনো প্রণোদনা বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা-নীতিমালা এখনও প্রণয়ন করা হয়নি।
আরও বলা হয়, সরকারের প্রতি আস্থা রেখে পিএইচপি ফ্যামিলি দেশে সর্বপ্রথম মালয়েশিয়ার বিখ্যাত প্রোটন কোম্পানির কারিগরি সহায়তায় পূর্ণাঙ্গ একটি অটোমোবাইল (মোটরকার) সংযোজন কারখানা স্থাপন করেছে। বর্তমানে এ কারখানা থেকে সম্পূর্ণ দেশে তৈরি ব্র্যান্ড নিউ প্রোটন-পিএইচপি কার বাজারজাত করা শুরু হয়েছে। এ কারখানায় গাড়ি তৈরির সব অত্যাধুনিক মেশিনারি ও যন্ত্রাংশ স্থাপন এবং প্রচুর জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ব্যাপক পরিসরে পূর্ণাঙ্গ গাড়ি প্রস্তুত করা হলেও শুল্ককর কাঠামো ও উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মূসক আরোপ করায় বাজারজাত করার ক্ষেত্রে আমদানি করা গাড়ির সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। সম্পূর্ণ দেশে তৈরি মোটরকার ও আমদানি করা রিকন্ডিশন্ড মটরকারের শুল্ককর কাঠামোয় তেমন কোনো পার্থক্য নেই, বরং উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মূসক-বোঝার কারণে বিনিয়োগ হুমকির মুখে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে তৈরি গাড়িশিল্প স্থাপনা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সফলতার মুখ দেখেনি। প্রোটন, মিতসুবিশি, মারুতি-সুজুকি, হিরো হুন্ডা ও টাটা প্রাথমিক অবস্থায় যৌথ উদ্যোগে গাড়ি সংযোজন ও উৎপাদন শুরু করে। পরে প্রযুক্তি স্থানান্তর, শুল্ককর ও ট্যারিফ সুবিধার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মালয়েশিয়া, ভারত, চীনসহ অন্যান্য দেশে গাড়ি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। মালয়েশিয়া, ভারত, চীন, কোরিয়াসহ বিশ্বের সব দেশেই অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি পলিসি রয়েছে এবং এর আওতায় দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্ককর সুবিধা ভোগ করে আসছে। এসব সুবিধার কারণে মাত্র ২০ বছরেই পার্শ^বর্তী দেশ ভারতের অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে প্রসার লাভ করেছে। ভারতে অটোমোবাইল খাত জিডিপিতে সাত শতাংশ অবদান রাখছে, যা আমাদের দেশে কল্পনাতীত। আামদানি-নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটি সমন্বিত করনীতি প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে স্থাপিত মটরকার উৎপাদন ও সংযোজন শিল্পকে প্রণোদনা দিতে উৎপাদনে ব্যবহার করা প্রয়োজনীয় উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ সম্পূর্ণ বিযুক্ত অবস্থায় আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ককর ও উৎপাদন পর্যায়ে মূসক প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ার বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান প্রোটন-এর সঙ্গে যৌথ ব্যবস্থাপনায় দেশে প্রথম সেডান কার উৎপাদন শুরু করে পিএইচপি ফ্যামিলি। প্রায় চারশ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামে আনোয়ারায় ৩০ একর জায়গার ওপর কারখানা স্থাপিত হয়েছে। দেশে প্রতিবছর ১৪-১৫ হাজার গাড়ি আমদানি হয়ে থাকে, যার প্রায় ৭০ শতাংশই সেডান কার। প্রায় ৯৮ শতাংশ পুরোপুরি প্রস্তুতকৃত গাড়ি দেশে আমদানি করা হয়। দুই থেকে তিন শতাংশ গাড়ির ইঞ্জিনসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ দেশে সংযুক্ত করে পুরোপুরি গাড়ি প্রস্তুত করা হয়।
এ বিষয়ে পিএইচপি ফ্যামিলির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন শেয়ার বিজকে বলেন, গাড়ি আমদানি করলে যে পরিমাণ শুল্ক-কর দিতে হয়, আমাদেরও করও প্রায় কাছাকাছি নিয়ে গেছে সরকার। আমদানি করা গাড়িতে আমদানিকারকের কোনো বিনিয়োগ নেই। গাড়ি দেখে, এলসি খুলে গাড়ি এনে শো-রুমে ফেলে রাখে। অনেক সময় শো-রুমে না এনে বন্দরেই বিক্রি করে দেয়। যেহেতু তাদের কোনো অবকাঠামো নেই, সেহেতু তারা ভ্যালু অ্যাড করছে না। আমরা ভ্যালু অ্যাড করছি। এতে আমদানি করা গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরা টিকে থাকতে পারব না।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয়ভাবে গাড়ি উৎপাদনে আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে, আরও হবে। প্রায় চার শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া একটি গাড়ি বানাতে কম হলেও তিন হাজার যন্ত্রাংশ লাগে। এজন্য আগামীতে বিনিয়োগ হবে। তাই আমাদের যদি শুল্ককর সুবিধা দেওয়া না হয়, তাহলে এ খাত এগোবে না। এজন্য একটি সমন্বিত করনীতি প্রণয়ন এবং সরকারি সহায়তার সুপারিশ করেন তিনি।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, শুধু মোটরকার নয়, দেশে যেকোনো ভারী শিল্প স্থাপনে সব সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া রফতানিতে প্রণোদনা দেওয়া হবে। দেশে গাড়ি উৎপাদন করা হলে দেশের অর্থনীতি বড় হবে, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়বে। পিএইচপিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গাড়ির মতো বড় শিল্প স্থাপনে এগিয়ে এসেছে। এ খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে সরকার কর বিষয়ে ছাড় দেবে। তিনি বলেন, গাড়ি সংযোজন ও উৎপাদনকে আমরা উৎসাহিত এবং আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে চাই।
গাড়ি তৈরিতে সরকারি সহযোগিতা নেই!
