একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইওর সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাব কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সবসময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন টপ ম্যানেজমেন্ট। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার গ্রামীণফোনের কোম্পানি সচিব হোসেন সাদাত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস
শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ার গড়ার পেছনের গল্প দিয়েই শুরু করতে চাই…
হোসেন সাদাত: আমার ক্যারিয়ারের শুরু ১৯৯৭ সালে, বহুজাতিক একটি অডিট ফার্মের মাধ্যমে। এরপর দুইটি বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানিতে কাজ করেছি। তারপর প্রায় ১৫ বছর গ্রামীণফোনের সঙ্গে আছি। বর্তমানে আমি গ্রামীণফোনের রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক এবং কোম্পানি সচিব হিসেবে একসঙ্গে কাজ করছি। কোম্পানি সচিব হিসেবে ক্যারিয়ার গড়বো- এমন কোনো পরিকল্পনা কখনও ছিল না। আমার স্বপ্ন ছিল বহুজাতিক কোনো কোম্পানিতে ক্যারিয়ার গড়া। সেটা হিসাবশাস্ত্রে হোক, ফিন্যান্সে হোক বা কোম্পানি সচিব হিসেবে হোক। সেভাবেই আমার যাত্রা শুরু। আমি মূলত ব্যবসায় শাখার ছাত্র। আমি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছি। তারপর আমি পড়াশোনা করেছি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সিতে, এরপর চার্টার্ড সেক্রেটারি কোর্সও করেছি। করপোরেট ক্যারিয়ারে শুধু কোম্পানি সচিব হিসেবে কাজ করেছি, তা কিন্তু নয়। এই সময়ের মধ্যে আমি বহু চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি। ফিন্যান্স নিয়ে কাজ করেছি, অ্যাকাউন্ট্যান্সি নিয়ে কাজ করেছি। একসময়ে গ্রামীণফোনে ফিন্যান্সিয়াল কন্ট্রোলার হিসাবেও কাজ করেছি। তারপর কোম্পানি সচিব হিসাবে কাজ করার একটা সুযোগ এসেছিল। যেহেতু আমার চার্টার্ড সেক্রেটারি কোয়ালিফিকেশনটা ছিলো, আমি সেই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করি।
শেয়ার বিজ: গ্রামীণফোনের সঙ্গে পাঠকদের কিভাবে পরিচয় করিয়ে দেবেন?
হোসেন সাদাত: গ্রামীণফোন বাংলাদেশের মোবাইল ফোন সেবা প্রদানকারী একটি কোম্পানি। এটি ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন সেবাদাতা কোম্পানি এটি। গ্রামীণফোন নরওয়ের টেলিনর গ্রুপের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। এটির মোট শেয়ারের ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশের মালিক টেলিনর। এছাড়া গ্রামীণ টেলিকম ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিক।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের টেলিকম খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
হোসেন সাদাত: টেলিকম খাত বেশ ভালো করছে। সম্প্রতি আরেকটি ভালো ঘটনা ঘটেছে, তা হলো রবি-এয়ারটেল একীভূত হওয়া। আমি মনে করি, এতে বাজারে প্রতিযোগিতা ভালো হবে। গ্রাহকরা নতুন নতুন সেবা ও বৈচিত্র্যময় পণ্য পাবেন। এটা কোম্পানি, বিনিয়োগকারী ও গ্রাহক সবার জন্যই ভালো হবে বলে মনে করি।
শেয়ার বিজ: বর্তমান টেলিকম খাতের সম্ভাবনা কেমন?
হোসেন সাদাত: এ খাত সম্ভাবনাময়। তারপরও খাতটির একমাত্র কোম্পানি হিসেবে শুধু আমরাই তালিকাভুক্ত হয়েছি। আমি মনে করি, এ খাতের অন্য কোম্পানিগুলোকেও তালিকাভুক্তির জন্য এগিয়ে আসা উচিত। তাহলে পুঁজিবাজারে গতি আনতে টেলিকম খাত অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।
শেয়ার বিজ: গ্রামীণফোনের বিশেষ কোনো সফলতার কথা বলবেন কি?
হোসেন সাদাত: আমাদের সফলতা অব্যাহত রয়েছে। আমরা দেশের প্রথমদিকের কোম্পানি হিসাবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পেরেছি। আমরা থ্রিজি সার্ভিস দিতে পেরেছি। আমরাই প্রথম বাংলাদেশে জিএসএম টেকনোলজি এনেছি। আমাদের কাছেই দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। গ্রাহকদের সন্তুষ্টির জন্য আমরা নতুন নতুন ডিজিটাল উদ্যোগ নিয়ে আসছি। বিভিন্ন পণ্য ও সেবা আরও সহজতর করেছি। গ্রাহকদের ডিজিটাল লাইফে সহযোগিতার জন্য নতুন নতুন আইডিয়া, প্রডাক্ট নিয়ে আসছি। সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা ব্যবসায়ও বেশ ভালো করছি। আমাদের বিনিয়োগকারীদের নিয়মিতভাবে উলেস্নখযোগ্য হারে লভ্যাংশ দিতে পারছি। ব্যবসার বর্তমান প্রবৃদ্ধি বা উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে কাজ করে যাচ্ছি। স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পেলে আগামী দিনগুলোতে আমরা সফলতার এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারবো।
শেয়ার বিজ: কোম্পানির সঙ্গে সচিবের সম্পর্কটা কেমন?
হোসেন সাদাত: দেখুন, কোম্পানির সঙ্গে সচিবের সম্পর্কের কথা বলতে গেলে প্রথম যে কথাটা আসে, সেটা হলো ‘বিশ্বাস’। কারণ কোম্পানি সচিবকে বিনিয়োগকারী ও পরিচালনা পরিষদের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে হয়। তাই এটি আসলে বিশ্বাসের সম্পর্ক। কারণ এখানে ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গুরুত্বপ–র্ণ ইস্যু পরিচালনা পরিষদের কাছে তুলে ধরতে হয়। পরিচালনা পরিষদে আলোচনা করে সেখান থেকে দিকনির্দেশনা আনতে হয়। একইসঙ্গে স্থানীয় আইন, সিকিউরিটিজ আইন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিভিন্ন নিয়ম-কানুন এ সবকিছুর কমপস্নায়েন্স নিশ্চিত করে পরিচালনা পরিষদকে অবগত করতে হয়।
শেয়ার বিজ: এ পেশার গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
হোসেন সাদাত: আমি মনে করি, কোম্পানি সচিব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অবস্থান। এটার দায়িত্বও অনেক বেশি। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা একমাত্র কোম্পানি সচিবের মাধ্যমেই কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সচিব একদিকে যেমন ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পরিষদের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করে, একইভাবে কোম্পানির সাধারণ বিনিয়োগকারী ও কোম্পানির মধ্যেও সেতু হিসেবে কাজ করতে হয়। সেই হিসেবে একজন সচিবের দায়িত্ব অনেক বেশি, বছর শেষে একজন কোম্পানি সচিবকেই সুন্দর একটি বার্ষিক সাধারণ সভা উপহার দিতে হয়। সেটা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অধিকার। সুতরাং একজন সচিবকে সাহসিকতা ও যোগ্যতার সঙ্গে কার্যকর উপায়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই পেশা হিসেবে এটি নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
শেয়ার বিজ: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
হোসেন সাদাত: তুলনামূলক অন্য পেশা থেকে এ পেশার সুযোগ অনেক বেশি। এ পেশায় কেউ ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে আমি তাদের সাধুবাদ জানাবো। ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থীদের এ পেশা বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেব।
শেয়ার বিজ: এই পেশার সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
হোসেন সাদাত: আমাদের দেশে এ পেশার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। যত বেশি কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হবে তত বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। তবে শুধু তালিকাভুক্ত কোম্পানিই নয়, দেশে কোম্পানির সংখ্যা বাড়লে সুযোগও বাড়বে। কারণ তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়, সব কোম্পানিতেই কোম্পানি সচিব প্রয়োজন মনে করি। সেই হিসেবে এ পেশার সম্ভাবনা অনেক। বাজারে কোম্পানির সংখ্যা বাড়লে কোম্পানির দায়িত্বও বাড়বে। সেসঙ্গে এ পেশার প্রসার ঘটবে।
শেয়ার বিজ: দায়িত্ব পালনে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখতে আপনার মূলমন্ত্র কী?
হোসেন সাদাত: প্রথম কথা হলো- আপনাকে বিনয়ী হতে হবে। আপনি যার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তার সঙ্গে যুক্তিসঙ্গতভাবে, বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। যদি এটি পারেন, তাহলে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে।
শেয়ার বিজ: একজন সফল কোম্পানি সচিবের কী কী গুণ থাকা জরুরি?
হোসেন সাদাত: সফল কোম্পানি সচিব হতে হলে তাকে বিনয়ী হতে হবে, জ্ঞানী ও পরিশ্রমী হতে হবে। করপোরেট জগতে টিকে থাকার জন্য, নিজেকে কার্যক্ষম রাখার জন্য সবসময় শিখতে হবে। এখানে শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। নিজের জানার পরিধি বৃদ্ধি করে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতির জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে।
শেয়ার বিজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
হোসেন সাদাত: আপনাকেও ধন্যবাদ।
Add Comment