গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশিত ‘ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য, বাড়ছে শেয়ারদর’ শীর্ষক খবরটি অনেক পাঠকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ‘বাবু খান’ নামের একজন ব্যবহারকারী ‘ডিএসই স্মল ইনভেস্টর ক্লাব’ নামের এক পাবলিক গ্রুপ পেইজে ন্যাশনাল ফিডের ট্রেডিং কোড (এনএফএমএল) সম্পর্কে লিখেছেন, “…শুধু জুন ’১৬ পর্যন্তই উৎপাদন ৫৩ শতাংশ, ইপিএস ১.৭৯; সব ঋণ পরিশোধ, বিদেশি নতুন মেশিনে চারগুণ উৎপাদন শুরু হয়েছে, নিজস্ব মেশিনে সয়াবিন উৎপাদন ও বাজারজাত। ডিসেম্বর ’১৬-য় আসছে কোয়ার্টারে উৎপাদন ও ইপিএস ডাবল (দ্বিগুণ) হবে। এবার বুঝে দেখুন দাম কোথায় ঠেকবে…।”
ফেসবুকে প্রচারিত ওই ভ্রান্ত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতা অসংগতিপূর্ণ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বলছে, জুন ক্লোজিংয়ের কারণে ১৮ মাসে অর্থবছর হওয়ায় কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬ সালে বেড়েছে ৪ কোটি ৬ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে। একই সময় আগের বছরের তুলনায় তিন পয়সা কমেছে শেয়ারপ্রতি আয় তথা ইপিএস। এদিকে কোম্পানির উৎপাদন বৃদ্ধি সম্পর্কে দেওয়া তথ্য অতিরঞ্জিত এবং কোম্পানি কর্তৃক সব ঋণ পরিশোধ বিষয়ে পরিবেশিত তথ্যও অসত্য। অথচ বলার অপেক্ষা রাখে না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো এসব বিভ্রান্তিকর ও মূল্য সংবেদনশীল তথ্য পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।
আমরা অবশ্য মনে করি, অনলাইনে অসত্যের এ প্রসার কেবল শেয়ারবাজারে নয়, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য খবরাখবরেও গুজবের প্রাধান্য দৃশ্যমান। সেজন্যই দেখা যায়, গুজব-নির্ভর ইন্টারনেট মাধ্যমগুলো জনপ্রিয়তার দিক থেকে তুলনামূলক এগিয়ে। কথা হলো, কোন তারকা কোন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন, সেই মিথ্যা তথ্য সামাজিকভাবে যতটা না ক্ষতিকারক, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক পুঁজিবাজার ঘিরে প্রকাশিত ভ্রান্ত তথ্যাবলি। অনস্বীকার্য, গুজবে ওই তারকা হয়তো ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অন্যদিকে মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে পারেন বিনিয়োগকারী। তাই নিঃসন্দেহে সংবেদনশীল ইস্যুতে গুজবের ক্ষতিকারক প্রভাব অনেক বেশি। লক্ষণীয়, কেবল বাংলাদেশ কেন সারা বিশ্বেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অপব্যবহারপূর্বক বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য প্রচার অব্যাহত। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সেগুলোর লাগাম টেনে ধরতেও তৎপর। তবে অনেক সময় নাগরিকের বাকস্বাধীনতা সুরক্ষা সম্পর্কিত আইনের কারণে তাদের প্রচেষ্টা রহিত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে সেই বিপত্তি কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগও পরিলক্ষিত। আমাদের দুর্ভাগ্য, ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর গুজবের সম্প্রসারণ রোধ ব্যতীত সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুল বা অতিরঞ্জিত অর্থনৈতিক-আর্থিক তথ্যাদির বিস্তার রোধে প্রচেষ্টা খুব কম। আমাদের প্রতিবেদক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানো অন্তত শতাধিক পেইজ সম্পর্কে তথ্য দেওয়া সত্ত্বেও আজও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এমন পরিস্থিতি কাম্য হতে পারে না। বরং এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে দ্রুত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে বিটিআরসি’র দৃষ্টি আকর্ষণই করতে চাইবেন সবাই। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, মূলধারার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমগুলো শক্তিশালীকরণ। যেকোনো পুঁজিবাজারের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার এ এক অপরিহার্য (বেসরকারি) উপাদান। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে উপাদানটি এখনও মোটের ওপর অবহেলিত। ফলে এর প্রতি নিয়ন্ত্রকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম শক্তিশালী হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীর বাজার সচেতনতা বাড়বে। আর সচেতন বিনিয়োগকারীরা গুজব ও বিভ্রান্তি থেকে নিজেদের দূরে রাখেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
Add Comment