নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ২০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, যা দেশের মোট উৎপাদনের দুই শতাংশ। ২০১০ সালেও প্রতিবেশী দেশ ভারতে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন এর চেয়ে কম ছিল। কিন্তু গত বছর দেশটি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে ২০ গিগাওয়াট। আর চীন গত তিন মাসে ৯ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। দেশে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ভারতের মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশের মতো হলে তা যথাযথ হতে পারত। কিন্তু তা হচ্ছে না।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজে (এমসিসিআই) অনুষ্ঠিত ‘পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধি’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। গতকাল এমসিসিআই সম্মেলন কক্ষে ব্যারিস্টার নিহাদ কবিরের সভাপতিত্বে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সৌরবিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশের সাফল্য এবং পোশাক খাতে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা করেন বেসরকারি ও উন্নয়ন সংস্থার শীর্ষস্থানীয়রা।
ইউকেএইড, ডিএফআইডির অর্থায়নে এ সভা আয়োজনের যৌথভাবে সহায়তা করে অ্যাডাম স্মিথ ইন্টারন্যাশনাল ও ইকোনমিক ডায়ালগ অব গ্রিন গ্রোথ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিএডি) পরিচালক ড. সেলিমুল হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় অংশ নেন রহীমআফরোজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ার মিসবাহ মঈন, ইডকলের কর্মকর্তা এসএম মনিরুল ইসলাম, প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হক, বিজিএমইএ’র সহসভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাসির, বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ড. মাশরুর রিয়াজ প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে এমসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, ‘পরিবেশগত সক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। ইপিআই-২০১৮ সূচকে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯ নম্বরে অবস্থান করছে। এ বাস্তবতায় দূষণ রোধ, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের বিষয়ে আমাদের প্রতিশ্রুতি পালনের সময় এসেছে। এ অবস্থায় আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।’
এ সময় আলোচনায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ ২০০২ সাল থেকে গৃহস্থালিতে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন শুরু করে। এখন দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ সোলার প্যানেল ব্যবহার করে। বাংলাদেশ সে হিসেবে ‘সোলার নেশন’-এ পরিণত হয়েছে। সৌরবিদ্যুতের ব্যাটারি থেকে শুরু করে সব ধরনের সাপ্লাই চেইন দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকেই আসছে। কিন্তু শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে আমাদের খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে রহীমআফরোজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ার মেসবাহ মঈন বলেন, দেশে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাসাবাড়িতে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়। সেচের জন্যও সৌর প্যানেল ব্যবহƒত হচ্ছে। কিন্তু এখনও লাখ লাখ বৈদ্যুতিক যানবাহনের চার্জ দেওয়ার জন্য সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়নি। এটি শুরুর জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ প্রয়োজন। এজন্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে পরিবেশবান্ধব শিল্পে অর্থায়নের জন্য নীতিগত প্রস্তুতি নেই। প্রচলিত পদ্ধতিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে গেলে বরং সহজে অর্থায়ন পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের চেয়ে ভারত ২০১০ সালেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে পিছিয়ে ছিল। এখন তারা ২০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
বিজিএমইএ’র সহসভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাসির বলেন, দেশের বেশ কিছু শিল্পে কারখানা সৌরবিদ্যুৎ ও বিভিন্ন গ্রিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সনদ অর্জন করেছে। কিন্তু এসব কারখানা পরিচালনা করার জন্য মধ্যম পর্যায়ের প্রযুক্তিবিদ ও পরামর্শক নেই দেশে। আমাদের শ্রীলঙ্কা ও ভারত থেকে পরামর্শক আনতে হয়। তিনি আরও বলেন, সবুজ শিল্পে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অর্থায়নের সুযোগ নেই। ফলে অনেকেই আগ্রহ দেখান না।
এ সময় বিশ্বের শীর্ষ গ্রিন কারখানা প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হক বলেন, ‘আমরা বিপুল অর্থ ব্যয়ে কারখানা গ্রিন করেছি। কিন্তু এজন্য আমাকে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এক ডলারও বেশি মূল্য দেয় না। তবে গ্রিন কারখানার কারণে আমি বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সমঝোতা করার সময় আত্মবিশ্বাস পাচ্ছি, সেটা আমার ব্যবসাকে স্থায়িত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংয়ের সুযোগ বাড়িয়েছে।
অপর এক আলোচক বলেন, বিদেশি পরামর্শকরাই বিদেশি প্রযুক্তি আনতে বাধ্য করছেন দেশের শিল্প-কারখানাগুলোকে। অথচ আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোও ২৫ বছরের গ্যারান্টি, ইন্স্যুরেন্সসহ সৌর প্যানেল স্থাপন করতে সক্ষম। এ অবস্থায় দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা দরকার।
সঞ্চালক সেলিমুল হক বলেন, সবকিছুর মধ্যে অব্যবস্থাপনা রয়েছে। অব্যবস্থাপনা সমুদ্রের মধ্যে কয়েকটি সবুজ দ্বীপ গড়ে তুললে তা কাজে আসবে না। আমাদের সার্বিকভাবে গ্রিন উন্নয়নের দিকে যেতে হবে। সেজন্য বৈশ্বিক গ্রিন ফাউন্ডিংয়ের সহায়তা নেওয়ার চেষ্টাও করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা মাশরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রবৃদ্ধির যে কৌশল রয়েছে, তার সঙ্গে সবুজ ও পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধিকে সমন্বয় করতে হবে। এজন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, সচেতনতা সৃষ্টি, নীতিগত সংস্কার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অর্থায়ন ফান্ড থেকে সুযোগ নিতে হবে। এজন্য বেসরকারি ও সরকারি পর্যায়ের মধ্যে আলোচনা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তিনি।