শেখ আবু তালেব: বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-সহায়তার কারণে দেশের ব্যাংকগুলোয় নগদ টাকার সংগ্রহ রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ। অনেক ব্যাংকে এখন অতিরিক্ত তারল্য। আন্তঃব্যাংক রেপো সুদহার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে এক টাকার কমে নেমেছে। অথচ কিছুদিন আগেও সাত টাকায় উঠেছিল সুদহার। অপরদিকে গত আট বছরের নিচে নেমেছে কলমানি মার্কেটের সুদহার। উদ্ধৃত তারল্য ব্যাংকগুলো মাত্র শূন্য দশমিক ২১ টাকা সুদে বিনিয়োগ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে।
প্রসঙ্গত, আন্তঃব্যাংক রেপো থেকে এক থেকে সাত দিনের মধ্যে পরিশোধযোগ্য স্বল্প সময়ের জন্য এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের কাছ থেকে সুদে নগদ টাকা সংগ্রহ করে থাকে। অপরদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের কাছ থেকে যে টাকা ধার নেয়, তাকে কলমানি বলা হয়। এ মার্কেটেও সুদহার নেমেছে আট বছরের মধ্যে সর্বনি¤েœ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর পরিমাণ নগদ অর্থ রয়েছে, তাই কম সুদেই এক ব্যাংক অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিচ্ছে। কিন্তু অতিরিক্ত তারল্যের পরও ঋণের সুদহার ডাবল ডিজিটেই রয়েছে এখনও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে আন্তঃব্যাংক রেপোতে সুদহার ছিল ৯ টাকার ওপরে। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই তা দাঁড়ায় এক টাকায়। ওইদিন সর্বোচ্চ সুদহার ছিল সাত টাকা। সেদিন লেনদেন হয়েছিল প্রায় এক হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে জানুয়ারি মাসে সুদহার দাঁড়ায় তিন টাকার ওপরে। তারপর থেকে টাকা নেওয়ার পরিমাণ সময় সময় বৃদ্ধি বা কম হলেও সুদহার কমেনি কখনও। বরং সময়ের আলোকে বেড়েই চলেছে।
সর্বশেষ গত এপ্রিলের প্রথম দিকেও এ বাজারে সুদহার ছয় টাকা ৭৫ পয়সায় উঠেছিল। কিন্তু মাস শেষের দিকে তা কমে একবারে দুই টাকায় নামে। ১০ মে সুদহার নেমে দাঁড়িয়েছে ৮০ পয়সায়। এদিন সুদহার কমার পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণও কমে গেছে। লেনদেন হয়েছে ২৩৫ কোটি টাকা। অপরদিকে কলমানি মার্কেটে সুদহার নেমেছে ৭৫ পয়সায়। গড় সুদহার ছিল দুই টাকা ৭০ পয়সা। এদিন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধার নিয়েছে চার হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে দৈনিক নগদ জমার (সিআরআর) যে অংশটুকু কম জমা দিচ্ছে, এটি সেই তারল্য। কিন্তু এটি বিনিয়োগ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। তাই বলা যায়Ñব্যাংকে তারল্য বেড়েছে। কিন্তু এটি সাময়িক না দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
যদিও এর সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ গতকাল এক সেমিনারে বলেন, দেশের ব্যাংকগুলো কদিন আগেও বলেছিল তারল্য বেশি। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই শুনছি তারা তারল্য সংকটের মধ্যে আছেন। কিন্তু অর্থনীতির স্বাভাবিক হিসাব অনুযায়ী তারল্য সংকট হলে তো ‘কলমানি রেইট’ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কলমানি রেইট তো বাড়েনি। তার মানে হচ্ছে তারল্য সংকট প্রকৃতপক্ষে যা, তা হয়নি। এখানে ব্যাংকগুলোর মালিকরা অস্বাভাবিকভাবে ঋণ নিয়ে ব্যাংক খাতকে সমস্যায় ফেলেছেন।
এদিকে গত ৩০ এপ্রিলও আন্তঃব্যাংক রেপোতে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৪১২ কোটি টাকা। গড় সুদহার ছিল দুই টাকা। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে বর্তমানে লেনদেনের পরিমাণের পাশাপাশি কমেছে সুদহার। এ চিত্র বলে দেয়, এখন ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। তাই স্বল্প সুদেও কেউ টাকা নিচ্ছে না।
মূলত গত বছরের শেষে দেশের অধিকাংশ ব্যাংকই আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পড়ায় বাড়তে থাকে আন্তঃব্যাংক রেপো সুদহার। আগ্রাসী ব্যাংকিং ঠেকাতে বছর শেষে গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিদ্যমান ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য এক শতাংশ কমিয়ে ৮৯ শতাংশ ও প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য দেড় শতাংশ কমিয়ে ৮৩.৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। এডিআর সমন্বয়ে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। তখন প্রায় ১৫টি ব্যাংক এ সমন্বয় করতে গিয়ে নগদ টাকার সংকটে পড়ে। তখনও কলমানি মার্কেটের পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক রেপোতে টাকা লেনদেনের পরিমাণ প্রায় একই ছিল।
ওই সময় কলমানি মার্কেটে সুদহার স্থিতিশীল থাকলেও আন্তঃব্যাংক রেপোতে তা স্থিতিশীল থাকেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যমতে, দেশের প্রায় ১৫টি ব্যাংক নগদ টাকার সংকটে ভুগছিল। তারা এখনও এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাকি ব্যাংকগুলোয় টাকার সমস্যা নেই। কিন্তু তারাও প্রচার করতে শুরু করে ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট রয়েছে। এডিআর সমন্বয়ে বাড়তি সুদে আমানত সংগ্রহে নেমে পড়ে সবাই। ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রায় ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহে নেমে পড়ে। ফলে সিঙ্গেল ডিজিটে থাকা আমানত সংগ্রহের সুদহার ডাবল ডিজিটে উঠে যায়।
নগদ টাকার প্রবাহ বাড়াতে ব্যাংক উদ্যোক্তা পরিচালকদের চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংকে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দৈনিক নগদ জমার হার (সিআরআর) এক শতাংশ কমানো হয়। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় এমন সিদ্ধান্ত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া এডিআর সমন্বয়ের সীমা প্রথমে চলতি বছরের ডিসেম্বর ও পরবর্তীকালে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে গত ৩০ মার্চ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন, সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হবে, যা আগে ছিল ২৫ শতাংশ।
দেশের বেসরকারি এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, সরকারের এমন ঘোষণায় ব্যাংকগুলোয় প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য চলে আসে। ফলে ব্যাংকগুলোয় এখন আর নগদ টাকার কোনো সংকট নেই। যেসব ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল না, তাদের কাছেও অতিরিক্ত টাকা জমা হয়েছে। ফলে আন্তঃব্যাংক রেপোতে লেনদেনের পরিমাণ ঠিক থাকলেও কমে গেছে সুদহার। চড়া সুদের সময়েও যে অঙ্কের টাকার লেনদেন হতো, এখনও তা হচ্ছে। টাকার চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তঃব্যাংক রেপোতে কমে গেছে সুদহার। অনেক ব্যাংকই এখন হাতে থাকা টাকা এ বাজারে খাটাচ্ছেন।
অপরদিকে নগদ টাকার সরবরাহ বাড়লেও ঋণের বিপরীতে সুদহার কমায়নি ব্যাংকগুলো। ডাবল ডিজিট থেকে সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে যাওয়া সুদহার ফের ডাবল ডিজিটেই চলে গেছে। শিগগিরই যে কমবে, তারও কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।