রহমত রহমান: সিরামিক পণ্য উৎপাদন ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ফার সিরামিক লিমিটেডের বিরুদ্ধে প্রায় ২৫ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন কর বা মূসক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিক্রয় তথ্য গোপন ও মূসক চালান ব্যবহার না করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি এ বিপুল পরিমাণ ফাঁকি দিয়েছে। বকেয়া মূসক পরিশোধে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাথমিক দাবিনামা ও কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (উত্তর)। সম্প্রতি এ দাবিনামা জারি করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূসক আইন অনুযায়ী চূড়ান্ত দাবিনামা জারির পর বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ না করলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হবে। তবে ফার সিরামিক কর্তৃপক্ষ বলছে, সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এসব মূসক দাবি করা হচ্ছে। এনবিআরের হিসাবে ভুল রয়েছে। কাগজপত্র দেওয়া হলেও তারা তা আমলে নেয়নি।
সূত্র জানায়, এনবিআর অভিযোগ পায় ফার সিরামিক নামে একটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে পণ্য বিক্রয়ের প্রকৃত তথ্য বিক্রয় রেজিস্টারে উল্লেখ না করা, প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন ও মূসক চালান ব্যবহার না করার মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের মূসক ফাঁকি দিয়ে আসছে। বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরকে নির্দেশ দেয় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি মূসক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানটির গাজীপুর কারখানা ও ঢাকার ইস্কাটনে প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালায়। জব্দ করা কাগজপত্র যাচাই শেষে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রায় ২৫ কোটি টাকার মূসক ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। পরে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (উত্তর) কমিশনারেটে মামলা করা হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, মূসক ফাঁকির অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর ফার সিরামিকের গাজীপুরের ভবানীপুর নৌলাপাড়ার কারখানায় অভিযান চালানো হয়। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক (মূসক) মো. সামছুর রহমানের কক্ষ থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের মার্চ ও ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিক্রয় বিবরণী জব্দ করা হয়। এতে পণ্য বিক্রয় ও মূসক পরিশোধের মধ্যে পার্থক্য পাওয়া যায়। এছাড়া প্রকৃত বিক্রয়মূল্যের বিপরীতে মূসক প্রদান না করে বছরের পর বছর মূসক ফাঁকির তথ্য উঠে আসে। পরে কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কক্ষ তল্লাশি ও কম্পিউটার থেকে তথ্য নেয়। কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের প্যাকিং ফ্লোরে তল্লাশি করে নিজস্ব বাণিজ্যিক রেজিস্টারে কয়েক মাসের পণ্য ডেলিভারি-সংক্রান্ত রেজিস্টার ও কম্পিউটারে ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পণ্য ডেলিভারির তথ্য নেয়। একই সঙ্গে কারখানা থেকে উৎপাদন ও বিক্রয়-সংক্রান্ত বিপুল কাগজপত্র জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় থেকে ১৪টি কম্পিউটারের সিপিইউ ও ফাইল জব্দ করে।
জব্দ করা কাগজপত্র যাচাইয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৯৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা পণ্য মূল্যের ওপর মূসক ফাঁকি পর্যালোচনা করা হয়। এতে প্রায় ১৫ কোটি টাকার মূসক ফাঁকি পাওয়া যায়। সঠিক সময়ে মূসক পরিশোধ না করায় এর ওপর সুদ প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকাসহ মোট ফাঁকির পরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকার পণ্যের বিক্রয় তথ্য গোপন করে প্রায় তিন কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। এ সময়ে ফাঁকিকৃত মূসকের সুদের পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। সুদসহ মোট ফাঁকি প্রায় ছয় কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ৮২ কোটি ৪৬ লাখ টাকার পণ্যের বিক্রয়মূল্য গোপন করে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা মূসক ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁকিকৃত মূসকের সুদ প্রায় পাঁচ কোটি ৫৮ লাখ টাকাসহ প্রায় ১৮ কোটি টাকা ফাঁকি দিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের মার্চ ও ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ৯৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকার পণ্য বিক্রির আড়ালে মোট ১৫ কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর ৩৭ (৩) ধারা অনুযায়ী ফাঁকিকৃত মূসকের ওপর দুই শতাংশ হারে সুদ প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাণিজ্যিক দলিলে ডেলিভারি পণ্যের পরিমাণ প্রায় তিন কোটি ছয় লাখ পিস দেখানো হলেও বিক্রয় রেজিস্টারে প্রায় এক কোটি আট লাখ পিস সরবরাহ দেখিয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ কম দেখিয়েছে প্রায় এক কোটি ৯৯ লাখ পিস। এতে বুঝা যায়, প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার সময় সব পণ্যের বিপরীতে সঠিকভাবে মূসক চালান প্রদান করেন না। প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করার মাধ্যমে বছরে কোটি কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়ে আসছে।
সূত্র জানায়, অভিযানে প্রতিষ্ঠানের ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন ও ২০১২ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত প্রায় ২৪ লাখ পিস পণ্য সরবরাহের তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বিক্রয়মূল্যের তথ্য পাওয়া যায়নি। এর তথ্য পাওয়া গেলে মূসক ফাঁকির পরিমাণ অনেক বেড়ে যেত। অতিরিক্ত পণ্যের বিক্রয়মূল্য থেকে মূসক আদায় ও আরও কোনো কৌশলে প্রতিষ্ঠানটি মূসক ফাঁকি দেয় কিনা, তা যাচাই করতে কমিশনারেটকে অনুরোধ করেছে মূসক গোয়েন্দা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির মূসক ফাঁকির প্রবণতা বেশি এবং প্রতিষ্ঠানটিকে নজরদারিতে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের একজন সহকারী পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মূসক ফাঁকির সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালানো ও বিরাট অঙ্কের মূসক ফাঁকির তথ্য পাওয়ার পর মামলা করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়ের সব কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেলে ফাঁকির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যেত।
এ বিষয়ে ফার সিরামিক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান উদ্দিন রিফাত শেয়ার বিজকে বলেন, কমিশনারেট আমাদের কাছে ১০-১৫ বছরের ভ্যাট দাবি করেছে। আমার কোম্পানির বয়স হলো ১০ বছর। ভ্যাট অফিসের হিসাবে কিছু ভুল আছে। আমরা ভ্যাট অফিসকে বিষয়টি জানিয়েছি। ভ্যাট অফিস বলছে তারা পুনঃহিসাব করে আমাদের জানাবে। কিন্তু চূড়ান্ত কিছু জানায়নি। এর বাইরে আর কিছু বলতে পারছি না।
এ বিষয়ে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকার (উত্তর) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, প্রাথমিক দাবিনামা ও কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি শুনানিতে অংশ নিয়েছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে কাগজপত্র দিতে পারেনি। ভ্যাট ফাঁকি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এখন চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হবে। প্রতিষ্ঠানটি টাকা না দিলে ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হবে।
ফার সিরামিকের ভ্যাট ফাঁকি জব্দ হবে ব্যাংক হিসাব
