ইসমাইল আলী: প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে বরাবরই পিছিয়ে বাংলাদেশ, যদিও ধীরে ধীরে এ প্রবাহ বাড়ছিল। তবে ২০১৭ সালে বিদেশি বিনিয়োগে হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর দেশে এফডিআই প্রবাহ কমে গেছে সাত দশমিক আট শতাংশ। এর আগে ২০১৪ সালে দেশে এফডিআই কমেছিল, যদিও ২০১৭ সালে দেশ থেকে বিনিয়োগ বাইরে যাওয়া বেড়েছে প্রায় ৩১৯ শতাংশ।
এদিকে পার্শ^বর্তী দেশ মিয়ানমারে গত বছর এফডিআই প্রবাহ বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের দ্বিগুণ এফডিআই প্রবাহ পেয়েছে মিয়ানমার। এছাড়া এফডিআই আকর্ষণে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে ইথিওপিয়া, কম্বোডিয়া ও মোজাম্বিক।
জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এফডিআই প্রবাহে শীর্ষে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। ২০১৭ সালে দেশটিতে এফডিআই প্রবাহের পরিমাণ ছিল চার দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। গত বছর এফডিআই আকর্ষণে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ছিল ইথিওপিয়া ও কম্বোডিয়া। দেশ দুটিতে এ সময় এফডিআই প্রবাহ ছিল যথাক্রমে তিন দশমিক ৫৯ ও দুই দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা মোজাম্বিকে ২০১৭ সালে এফডিআই প্রবাহ ছিল দুই দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এফডিআই আকর্ষণে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে দেশে এফডিআই এসেছে দুই দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ কমেছে প্রায় সাত দশমিক ৭৮ শতাংশ।
এর আগে ২০১৬ দেশে এফডিআই প্রবাহ বেড়েছিল চার শতাংশ। এছাড়া ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয় ৪৪ শতাংশ। সে বছরই প্রথম এফডিআই প্রবাহ দুই বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। আর ২০১৪ সালে এফডিআই প্রবাহ ছিল এক দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ২০১৩ সালে এ প্রবাহ ছিল এক দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০১৪ সালে এফডিআই প্রবাহ তিন শতাংশ কমেছিল।
অবকাঠামো ঘাটতিতে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে না বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশের জন্য দুই বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম। এক্ষেত্রে আফ্রিকান যে দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে তাদের অর্থনীতির প্রকৃতি ভিন্ন ধারার। দেশগুলো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। পাশাপাশি কৃষিতে বড় ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে দেশগুলোর। এজন্য এসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ বেশি। বাংলাদেশে ওই খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে। তবে এ খাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেশি। আর অবকাঠামোগত দুর্বলতায় প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। এজন্য আশানুরূপ বিনিয়োগ এ খাতে আসছে না, অথচ মিয়ানমার দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বড় আকারের এফডিআর নিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত বছর দেশে এফডিআই আসা কমলেও বিনিয়োগ দেশের বাইরে যাওয়া বেড়েছে অনেক বেশি। এ সময় দেশ থেকে ১৭ কোটি ডলার বিদেশে বিনিয়োগ হয়েছে। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল মাত্র চার কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে বিদেশে বাংলাদেশের বিনিয়োগ বেড়েছে ১৩ কোটি ডলার বা ৩১৯ শতাংশ।
এদিকে বিনিয়োগ প্রবাহ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে নেমে গেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে শীর্ষে থাকা ভারতে গত বছর বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ছিল ৩৯ দশমিক ৯১৬ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসা পাকিস্তানে দুই দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার এফডিআই যায়।
আঙ্কটাডের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে বিশ্বে মোট বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ছিল নি¤œমুখী। এ সময় এফডিআই প্রবাহ ছিল প্রায় এক দশমিক ৪৩ ট্রিলিয়ন (লাখ কোটি) ডলার, ২০১৬ সালের তুলনায় যা ২৩ শতাংশ কম। সে বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় এক দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছিল। তবে চলতি বছর বিশ্বব্যাপী এফডিআই প্রবাহ সামান্য বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আঙ্কটাড বলছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং টেলিকম হলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ খাত। তবে গত বছর এ দুই খাতেই বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপ ছিল না। ফলে ২০১৭ সালে এফডিআই প্রবাহ কমে গেছে। তবে বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ নতুন ধরনের প্যাকেজ অফার করছে। আর তা হলো অর্থনৈতিক অঞ্চল। এতে জমির পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অন্যান্য পরিষেবা সরবরাহ করা হবে। এছাড়া ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) গঠন করা হয়েছে, যারা বিদেশি বিনিয়োগ সহজ করতে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে আগামী বছর এফডিআই প্রবাহ বাড়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে এফডিআই স্টক বাড়ছে বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। এতে দেখা যায়, ২০০০ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের আন্তঃপ্রবাহের স্টক ছিল দুই দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার। আর গত বছর তা আরও বেড়ে ১৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ স্টক বাড়ছে, এতে খুশির কিছু নেই। বিনিয়োগ বাড়লেই যে দারিদ্র্য কমবে কিংবা কর্মসংস্থান তৈরি হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিনিয়োগ যেটা হচ্ছে, তা কোন কোন খাতে, সেটা দেখার আছে। সামনেও হয়তো বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, কিন্তু এতে মানুষের জীবনমানের কতটা উন্নতি হচ্ছে, দারিদ্র্য পকেটগুলো থেকে মানুষকে বের করে আনা যাচ্ছে কি না, প্রবৃদ্ধি কতটা অর্জিত হচ্ছেÑএ বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।