অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: একটি জনস্বাস্থ্য সংকট পর্ব -১

আমরা এমন একটি গ্রহে বসবাস করি, যা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা পরিবেষ্টিত। যেখানে যাই না কেন খুব গরম বা খুব শীত অনুভূত হয়। যা-ই খাই না কেন, যা কিছু পরিধান করি না কেন, যা কিছু স্পর্শ করি না কেন সবকিছুই ব্যাকটেরিয়াবেষ্টিত। এরা এত ক্ষুদ্র যে, অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া আমরা এদের দেখতে পাই না।
জল, স্থল, অন্তরীক্ষ সর্বত্র বসবাসকারী এই প্রাণীটি যখনই অপেক্ষাকৃত অনুকূল পরিবেশ পায় তখনই দ্রুতহারে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। মানবদেহ ব্যাকটেরিয়ার এমনই একটি অনুকূল আবাসস্থল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত বলা হতো দেহে মানবকোষ অপেক্ষা ব্যাকটেরিয়ার কোষ ১০ গুণ বেশি। তবে অতিসম্প্রতি ইসরাইলভিত্তিক একটি গবেষণা বলছে, আসলে প্রায় সমান সংখ্যক মানবদেহের কোষ ও ব্যাকটেরিয়ার কোষ থাকে মানুষের শরীরে। বিষয়টি এমন যে, আমরা যতটুকু মানুষ ঠিক ততটুকু আবার এককোষী প্রাণী ব্যাকটেরিয়া। যদিও এত সরলভাবে কোনো কিছু বলা যায় না, তবে এযাবৎ যা জানা সম্ভব হয়েছে তার আলোকে বলা যায়, কিছু ব্যাকটেরিয়া মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক। আর মানুষের শরীরের বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়ার বাস মানুষের বৃহদন্ত্রে। এরা খাবার হজম, পুষ্টি শোষণ, কিছু ভিটামিন (ভিটামিন-বি) উৎপাদনে সহায়তাসহ অন্য ক্ষতিকর জীবাণুকে প্রতিরোধ করে। তবে উল্টোটাও আছে। এদের অনেকে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। যেমন নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, কলেরা প্রভৃতি।
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এসব রোগের চিকিৎসায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে মনে করেন, একজন মানুষ কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। আসলে ব্যক্তি নয়, ব্যাকটেরিয়া রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায় কোনো বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি। এর অর্থ হচ্ছে, ওই বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিকটি দিয়ে ওই ব্যাকটেরিয়াটিকে আর ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এই বিষয়টিকে বলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তখনই ঘটে যখন ব্যাকটেরিয়ার কোষে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে যার দরুন ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকটির কার্যকারিতা আগের মতো থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ওই ব্যাকটেরিয়াটি আগের থেকেও বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে।
উৎপত্তির সূত্র ধরে অ্যান্টিবায়োটিক শব্দটি দ্বারা ছত্রাক বা অন্য কোনো অণুজীব থেকে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত উপাদানকে বোঝায়, যা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে ব্যবহার করা হয়। প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিকের আদলে ল্যাবে কৃত্রিম অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করেও ব্যবহার করা হয়। ৬০ বছর ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের কারণে ব্যাকটেরিয়াঘটিত সেসব স্বাস্থ্যসমস্যার চিকিৎসা সম্ভব হয়েছে, যা একসময় কঠিন বা অসম্ভব ছিল। আলেকজান্ডার ১৯২৭ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। এটি প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৪০ সালে। এর পর থেকে নাটকীয়ভাবে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব এবং এসব রোগ থেকে মৃত্যুহার কমতে থাকে। আজকে যে মানুষের গড় আয়– বেড়েছে তাতে অ্যান্টিবায়োটিকের অনেক বড় অবদান রয়েছে। ধারণা করা হয় যে, অ্যান্টিবায়োটিকের কল্যাণে ১০ বছর গড় আয়– বেড়েছে মানুষের। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর অকার্যকর হয়ে পড়ার খবর শোনা যাচ্ছিল। বর্তমানে এই পরিস্থিতি এতটাই প্রকট যে, বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে পৃথিবী অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ শূন্য হয়ে যাবে, যদি নতুন কোনো ড্রাগ ডিজাইন করা না হয়।
বর্তমানে ব্যবহার করা প্রায় সব অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে। একটি ড্রাগ যদি আমেরিকায় কোনো ব্যাকটেরিয়ার প্রতি অকার্যকর হয়। অপরটি বাংলাদেশে কোনো ব্যাকটেরিয়ার প্রতি অকার্যকর হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের বিপরীতে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার ক্রমবিকাশ ঘটছে। আর এক জায়গায় ক্রমবিকশিত হওয়া রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। কেননা ব্যাকটেরিয়া মানুষের মতো বর্ডার আইন মেনে চলাফেরা করে না। তাই একসময় যেসব রোগ সহজেই চিকিৎসা করা যেত, এখন তা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। এদের মধ্যে আছে নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, রক্তে সংক্রমণ, গনোরিয়া, খাদ্যে বিষক্রিয়া প্রভৃতি। শুধু তা-ই নয়, এর ফলে বিশ্বের সব অস্ত্রোপচার, সিজারিয়ান সেকশন, ক্যানসার ট্রিটমেন্ট, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, হাড়সন্ধি প্রতিস্থাপনসহ আরও অনেক চিকিৎসা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে একসময় এসবের চিকিৎসা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগগুলো খুব চতুরতার সঙ্গে ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে। ব্যাকটেরিয়াতে এমন অনেক কেমিক্যাল আছে, যা মানুষের শরীরে নেই। অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগগুলোকে ল্যাবে এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে এগুলো ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরের বিশেষ কিছু কেমিক্যালকে চিনতে পারে যা মানুষের কোষের বাইরে নেই। এরপর এটি ওই কেমিক্যালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে, কোষকে ধ্বংস করে। মানুষের কোষের বাইরে ওই বিশেষ কেমিক্যাল না থাকায় অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ মানুষের কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। তবে ব্যাকটেরিয়া একটি জীবিত সত্তা, তাই অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এটি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপণ লড়ে যাবে এটিই স্বাভাবিক। আর এ স্বাভাবিক কাজটি করতে গিয়ে জš§ হবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার। তিনভাবে ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিককে প্রতিরোধ করে, অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে ওঠে।
প্রথমত, অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগকে বাধা দেয় যাতে সে ব্যাকটেরিয়া কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। এজন্য কখনও এরা কোষে প্রবেশের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়। কখনও আবার ঢুকে পড়া ড্রাগগুলো দ্বারা ক্ষতি সংঘটিত হওয়ার আগেই কোষের বাইরে এদের ছুড়ে মারে।
দ্বিতীয়ত, এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে। অর্থাৎ যে কেমিক্যালগুলো দেখে অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ ব্যাকটেরিয়ার কোষকে চিনতে পারে সে কেমিক্যালগুলোকে পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে পাশাপাশি অবস্থান করেও ড্রাগ এদের ভেতরে প্রবেশ করে না। কারণ যাদের মাধ্যমে তারা কোষে প্রবেশ করবে তাদের এরা পায় না।
তৃতীয়ত, সর্বশেষ উপায় হলো অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগকে ধ্বংস করা। এক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া এমন কিছু কেমিক্যাল ছুড়তে থাকে যে ব্যাকটেরিয়ার কোষের সংস্পর্শে আসার আগেই মিসাইলের মতো কেমিক্যালগুলো ড্রাগগুলোকে ধ্বংস করে দেয়।
নতুন বায়োকেমিক্যাল উৎপাদন বা বিদ্যমান কেমিক্যালের পরিবর্তন যাই করুক না কেন তার জন্য ব্যাকটেরিয়ার কোষে কিছু জিন থাকা প্রয়োজন। জিন হচ্ছে কোনো একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির জন্য দায়ী ডিএনএ অণু। এই যে আমরা কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কেউ গাঢ় বর্ণের, কেউবা হালকা বর্ণেরÑএসব আসলে ভিন্ন ভিন্ন জিনের জন্য হয়। ব্যাকটেরিয়ারও আছে এমন হাজারো জিন। যে ব্যাকটেরিয়াটি ৩৪০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে তার শরীরে এমন কোনো জিন আছে যা তাকে তাপসহিষ্ণু করেছে। আবার যে ব্যাকটেরিয়াটি ২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে তার শরীরে এমন কোনো জিন আছে, যা তাকে ঠাণ্ডাসহিষ্ণু করেছে। ঠিক একইভাবে যে ব্যাকটেরিয়াটি অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের উপস্থিতিতেও বহাল তবিয়তে থাকতে পারে তার শরীরেও এমন কোনো জিন আছে যা তাকে ওই অ্যান্টিবায়োটিককে প্রতিরোধ করে বেঁচে থাকার সক্ষমতা দিয়েছে। যে ব্যাকটেরিয়ার কোষে অ্যান্টিবায়োটিক-সহিষ্ণু জিন নেই সে সংবেদনশীল অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে মারা যাবে। আর যে ব্যাকটেরিয়ার কোষে অ্যান্টিবায়োটিক-সহিষ্ণু জিন আছে, সে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতেও সে বেঁচে থাকবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল একটি ব্যাকটেরিয়া রূপান্তরিত হয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী একটি ব্যাকটেরিয়ায়। তার কোষে তো অ্যান্টিবায়োটিক-সহিষ্ণু জিন ছিল না। তাহলে এই জিন সে কীভাবে ও কোথা থেকে পেল?
ব্যাকটেরিয়া বিস্ময়কর এককোষী জীব। আমাদের যাবতীয় জিনের অর্ধেক মা আর বাকি অর্ধেক বাবা থেকে পাই। এর বাইরে আর কোথাও থেকে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া তার আদি কোষ ছাড়াও বিভিন্ন উৎস থেকে জিন পেতে পারে। অর্থাৎ একটি ব্যাকটেরিয়া তার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিন নিজের শরীরে খুঁজে না পেলে অন্য জায়গা থেকে ব্যবস্থা করে নেবে। যেমন ব্যাকটেরিয়া অপর একটি মৃত ব্যাকটেরিয়া থেকে একটি জিন নিজের শরীরে নিয়ে নিতে পারে। বিষয়টি এমন যে, একজন লম্বা মৃত মানুষের এক টুকরো মাংস চিবিয়ে খেয়ে একজন খাটো মানুষ লম্বা হয়ে গেল। আবার ব্যাকটেরিয়া যখন ফ্লু ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন ব্যাকটেরিয়ার জিন ফ্লু ভাইরাসের মধ্যে ঢুকে যায়। এই ফ্লু ভাইরাসটি যখন অপর কোনো ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে তখন সেই জিনটি ওই ব্যাকটেরিয়াতে চলে যেতে পারে। এই বিষয়টি এমন যে, একটি লম্বা মানুষের শরীর থেকে কিছু ফ্লু ভাইরাস নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করে আপনি ফ্লু আক্রান্ত হলেন এবং লম্বা হয়ে গেলেন। এছাড়া একটি ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে অন্য ব্যাকটেরিয়া একটি কৃত্রিম সেতু তৈরি করে জিন আদান-প্রদান করে। একে ব্যাকটেরিয়ার যৌনমিলন বলে। এই বিষয়টি এমন যে, আপনি লম্বা একজন মানুষের সঙ্গে যৌন সঙ্গম করলেন। দিনশেষে আপনিও লম্বা হয়ে গেলেন। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকতে প্রয়োজনীয় জিন অনেকভাবে পেতে পারে। খোদ মানুষের শরীরেই ১০ হাজারের বেশি ধরনের ব্যাকটেরিয়া আছে। বাইরের পরিবেশের কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। এই ১০ হাজার ধরনের ব্যাকটেরিয়ার কারও না কারও পেনিসিলিনকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় জিন থাকতেই পারে। আর তা অন্য ব্যাকটেরিয়াতে স্থানান্তর হতেই পারে। কখনও কখনও এমনও হয় যে, একটি নিরীহ ব্যাকটেরিয়াতে একটি পেনিসিলিন-প্রতিরোধী জিন আছে, আর তাতে ক্ষতির কোনো কারণ ঘটে না। কিন্তু এই জিনটি যখন একটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াতে স্থানান্তর হয়ে একে পেনিসিলিন-প্রতিরোধী করে দেয় তখনই সর্বনাশটা হয়। (আগামী পর্বে সমাপ্য)

জুঁই ইয়াসমিন, পুষ্টি বিজ্ঞান প্রশিক্ষক

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০