আয়কর ফাইলে সই না করলে গুলি করার ‘হুমকি’

রহমত রহমান: ই-টিআইএন নিবন্ধন, রিটার্ন জমা ও মামলা। মাত্র ১৬ দিনে জাদুর কাঠিতে কাজ শেষ। দুই হেভিওয়েট করদাতাকে সুবিধা দিয়ে আলোচনায় অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (ইএসিটি) মো. সামসুদ্দিন। সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার থেকে ইএসিটি পর্যন্ত পদোন্নতি-পদায়নে ছিলেন কর অঞ্চল-১২, ঢাকায়। একটি কর অঞ্চলে ‘অদৃশ্য শক্তিবলে’ পদোন্নতি-পদায়নে অনিয়মের শক্ত শিকড় গাড়েন এই কর্মকর্তা। সুযোগ কাজে লাগিয়ে কয়েকশ বড় ফাইল নিজের কবজায় নেন। এই ফাইলে রাজস্ব ফাঁকি দিতে কাজে লাগান সব কৌশল। এই অনিয়মে এই কর্মকর্তা সঙ্গে নেন ছোট-বড় মো. মিজানুর রহমানকে। মিজানুর রহমান আইনজীবী বা আইটিপি না হয়েও ভাইয়ের সঙ্গে দাপিয়ে বেড়ান সার্কেল থেকে সার্কেলে।

দুই ভাই প্রভাব খাটিয়ে ফাইলে অনৈতিক সুবিধা বাগিয়ে নেন। কোনো কর্মকর্তা কর সুবিধা দিতে না চাইলে দেন হুমকি, করেন সম্মানহানি। সুবিধা না দেয়ায় এবার সহকারী কর কমিশনারকে (এসি) আয়কর ফাইলে সই না করলে পিস্তল দিয়ে গুলি করার হুমকি দিলেন। এই ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন এসি মো. রেজাউল গণি। ঘটনাটি ঘটেছে কর অঞ্চল-১২, ঢাকার আওতাধীন সার্কেলে (২৫৮, সাভার)। দুই ভাইয়ের হুমকিতে ওই সার্কেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কর কমিশনারকে ভিডিওসহ লিখিত

অভিযোগ দেয়া হয়েছে। ভিডিও, জিডি ও অভিযোগের কপি শেয়ার বিজের হাতে রয়েছে।

কমিশনারকে দেয়া চিঠি ও জিডিতে বলা হয়েছে, গত ২২ মে সকাল সাড়ে ১১টায় ইএসিটি সামসুদ্দিন, তার ভাই মিজানসহ কয়েকজন সাভার কর অফিসে আসেন। মো. রেজাউল গণির তাদের বসতে বলেন এবং আসার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। সামসুদ্দিন তার মোবাইল ফোন থেকে গণিকে দুটি ছবি দেখিয়ে বলেন, এই অফিস থেকে ডাকে বেনামি চিঠি পাঠানো হয়েছে। গণি বলেন, জরিপের এই ধরনের চিঠি কখনও ডাকে দেয়নি। জরিপের চিঠি সব সময় আমি ও কর পরিদর্শকের নেতৃত্বে টিম করে বাসায় বাসায় গিয়ে দিয়ে আসি, যাতে করনেট ও রাজস্ব কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথা বলার পরপরই ইএসিটি ও তার ভাই মিজান ২০২০-২১-এর অডিট তালিকাভুক্ত ‘রতন বণিক’-এর ফাইল দেখতে চান। গণি তাদের বারবার বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো কাগজ, অর্ডার শিট, ফর্ম বা ফাইল দেয়া যাবে না। রতন বণিকের ফাইল আমার কাছে নেই, রেঞ্জ স্যারের কাছে চলে গেছে। কিন্তু সামসুদ্দিন ও তার ভাই কথা না শুনে টেবিলের ওপর রাখা ফাইল জোর করে দেখা শুরু করেন। বাধা দেয়া হলে ভয় দেখাতে সাংবাদিক ডেকে আনেন, যারা অনুমতি ছাড়াই ভিডিও ধারণ করেন এবং ছবি তোলেন।

চিঠিতে আরও বলা হয়, দুই ভাই বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করেন, ১৪ মে এসি রতন বণিকের ওষুধের দোকানে গিয়ে ‘অর্ডার শিট’-এ জোর করে সই নিয়েছেন। গণির দাবি, ওই দিন তিনি অফিসের বাইরে যাননি। কর কর্মকর্তাদের ১০-১২ জনের জরিপ টিম রতন বণিক ও তার আশপাশের সব দোকান জরিপ শেষে শিটে সই নিয়েছেন। সামসুদ্দিন ও তার ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সামসুদ্দিন ও তার ভাই মিজান গণিকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। সামসুদ্দিন রুম থেকে বের হওয়ার সময় গণিকে উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘আমার একজন অফিস সহকারী আছেন। সে এলেই চোখ বন্ধ করে ফাইল সই করে দেবেন। না করলে এখানে থাকতে পারবেন না।’ পিস্তলের উদাহরণ দিয়ে হত্যার ও অপহরণের হুমকি দেন সামসুদ্দিন। আরও বলেন, ‘আমার কথামতো চললে এখানে কাজ করতে পারবেন, তা না হলে আপনাকে শেষ করে দেব।’

আরও বলা হয়, সামসুদ্দিন ৮২টি মামলার কথা বলেন। সামসুদ্দিন বর্তমানে খুলনা কর আপিল ট্রাইব্যুনালে কর্মরত। কিন্তু তিনি নিজের কর্মস্থল রেখে ২২ মে সাভার সার্কেল অফিসে এসে কর্মকর্তাকে হত্যার হুমকি ও সরকারি কাজে বাধা দেন। তার ভাই মিজান পে-অর্ডার জালিয়াতি, কর অফিস ও সোনালী ব্যাংকের সিল জালিয়াতি মামলা এখনও হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি পে-অর্ডার, চেক, সনদ, আয়কর প্রাপ্তি স্বীকারপত্র, রিটার্নসহ সব জালিয়াতি করে থাকেন। করদাতাকে ব্ল্যাকমেইল করে করের টাকা মেরে দেন। উৎসে করের টাকা নকল কাগজপত্র দিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে এডিট করে সমন্বয় করে এবং জাল দলিল সরবরাহ করে আসছেন। মূল কাগজ চাইলে কর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হুমকি দেয়। এর আগেও বহু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে অসদাচরণ ও সম্মানহানি করেছেন। সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই বড় ফাইলে কর পরিশোধ না করে পেশিশক্তি, হুমকি ও মানহানির ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। বড় উদাহরণ রতন বণিক। সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই অধিক্ষেত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হয়েও কোনো আয়কর দেন না। সামসুদ্দিন ও তার ভাইয়ের কারণে এই সার্কেলে কর আদায় কঠিন হয়ে পড়ছে, সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

সূত্রমতে, মিজানের নেই কোনো আইটিপি বা নেই আইনজীবী সনদ। সাভারে আয়কর অফিসের পাশে খুলে বসেছেন ‘ইনকাম ট্যাক্স অ্যাডভাইজার’ নামে প্রতিষ্ঠান। মিজান আয়কর বিভাগ বা এনবিআরের কোনো বিভাগে চাকরি করেন না। তবু তিনি গাড়িতে এনবিআরের লোগো ব্যবহার করেন। সবাই জানে মিজান আয়কর বিভাগে চাকরি করেন। সামসুদ্দিন ও মিজান দুই ভাই কর অঞ্চল-১২, ঢাকার আওতাধীন সাভার, ধামরাই, আশুলিয়া ও মানিকগঞ্জ সার্কেলে প্রায় এক হাজার আয়কর ফাইল করেন। মূলত সাভার, ধামরাই, আশুলিয়া ও মানিকগঞ্জ এলাকার বড় কর ফাইল দুই ভাই মিলে তদারকি করে আসছেন। কোনো কর্মকর্তা ফাইল অনুমোদন না করলে বা তাদের কথামতো কর নির্ধারণ না করলে তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেন। এসব ফাইল নিয়ন্ত্রণের জন্য দুই ভাই চারটি সার্কেলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, মো. সামসুদ্দিন ১৯৬৫ সালের ৭ মার্চ ঢাকায় জš§গ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালের ২১ জুন তিনি সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে এনবিআরে যোগ দেন। কর অঞ্চল-১২, ঢাকা নতুন হলে তিনি সেখানে যোগ দেন। পরে সেখান থেকে ২০১৭ সালের ২২ মার্চ কর পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ‘অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (ইএসিটি)’ হিসেবে পদোন্নতি পান। অর্থাৎ কর পরিদর্শক থেকে মাত্র এক বছর ১১ মাস ১৯ দিনের মাথায় তিনি ইএসিটি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। অনিয়ম শুরু চাকরির শুরু থেকে। মো. সামসুদ্দিন চাকরির শুরুতে কর অঞ্চল-১২, ঢাকার আওতাধীন আশুলিয়া, মানিকগঞ্জ সার্কেলে ছিলেন। এই সুবাদে চারটি সার্কেলে দুই ভাই মিলে সহস্রাধিক ফাইলে কবজায় নিয়ে অনিয়ম শুরু করেন। দুই ভাই অনিয়ম করে গেলেও তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্লেখ্য, মো. সামসুদ্দিন বর্তমানে খুলনা আপিলে কর্মরত। ২২ মে ছুটি না নিয়ে সাভার সার্কেলে এসে এসিকে হুমকি দেয়ার বিষয়টি খুলনা আপিল কর্তৃপক্ষ জেনেছে। এরই মধ্যে তাকে শোকজ করা হয়েছে।

সার্ভার সার্কেলে এসিকে হুমকি দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন ইএসিটি মো. সামসুদ্দিন। এমনকি ২২ মে তিনি ওই সার্কেল যাননি বলে জানান। সব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ফাইল করি না। যে জিডি করেছেন, তাকে এখন ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন জিডি আছে কি না। জিডি যে করেছেন, সে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’ পরে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।

অপরদিকে আইনজীবী বা আইটিপি সনদ নেই বলে স্বীকার করেন মো. মিজানুর রহমান। তবে এসিকে পিস্তলের হুমকি দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘পিস্তলের হুমকি কে দিয়েছেন? পিস্তলের কোনো কথাই ওঠেনি; বলেন, যে রতন বণিককে অর্ডার শিটে সই করিয়েছিলেন, সেই রতন বণিক গিয়েছেন। এসি অর্ডার শিট নিয়ে লুকোচুরি করেছেন। বণিক ফার্মেসি এনাম রোডের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফার্মেসি। যে অফিসার আসে সে মনে করে যে হিন্দু দোকান। তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা খেতে চান। তিনি (এসি) ফাইল অডিটে ফেলে, পরে তদন্তের জন্য পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছেন। আমার ভাই ফাইলটি করে ঠিক আছে।’ রতন বণিক তো লিখিত দিয়েছেন যে, তিনি অর্ডার শিট পড়ে সই করেছেনÑএ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হিন্দু মানুষ। তাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। রতন বণিক প্রথমে গিয়ে যে তর্ক করেছেন, স্যার, সাদা কাগজে যে আমার থেকে সই নিয়েছেন, সে অর্ডার শিট ফেরত দেন।’ চাকরি বাঁচাতে এসি রতন বণিকের কাছে মাফ চেয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে কর অঞ্চল-১২, ঢাকার একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, এসিকে হুমকি, কর আদায়ে বাধা ও দুই করদাতাকে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার বিষয়ে ইএসিটি সামসুদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। জিডি তদন্ত কাজ শেষ হলে মামলা করা হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০