সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম দুই মাসের ব্যবধানে কমেছে ৩২ শতাংশ। আর পাম তেলের দাম কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। বর্তমান দর অনুসারে লিটারপ্রতি সয়াবিনের দাম ১২৪ টাকা এবং পাম অয়েলের দাম ৭১ টাকা। অথচ দেশের বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন লিটারপ্রতি ১৯৯ এবং খোলা পাম ১৫৪ টাকা। যদিও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারে খোলা ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা কমে কেনাবেচা হচ্ছে।
জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে হয়েছিল টনপ্রতি এক হাজার ৯৫০ ডলার। গত বৃহস্পতিবার এ দর নেমে আসে টনপ্রতি এক হাজার ৩১৮ ডলারে। অর্থাৎ দেশের ডলার রেট বিবেচনায় (এক ডলার=৯৩.৯৫ টাকা) লিটারপ্রতি দাম ১২৪ টাকা। দুই মাসে দরপতন হয়েছে ৬৩২ ডলার বা ৩২ শতাংশ, যা ভোজ্যতেলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দরপতন।
অপরদিকে সয়াবিনের চেয়ে বেশি কমেছে পাম তেলের দাম। মালয়েশিয়ার কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বুশরা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভসে গত ৫ মে অপরিশোধিত পাম তেল বেচাকেনা হয় সাত হাজার ৩৮২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত। আর গত বুধবার ছিল তিন হাজার ৮৫০ রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি টাকায় লিটারপ্রতি ৭১ টাকা। অর্থাৎ দুই মাসে পাম তেলের দর কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।
সরেজমিনে গতকাল চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা যায়, সয়াবিন ও পাম তলের বাজার ছিল নিন্মমুখী। এ বাজারের বিশ্ববাজারের সঙ্গে প্রতি ঘণ্টায় দর ওঠানামা করে। বাজারে খোলা প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৫৮ টাকায়। দুই মাসের ব্যবধানে লিটারপ্রতি দাম কমেছে ২০ থেকে ২২ টাকা। আর পাম তেল লিটারপ্রতি ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে ১১২ টাকা ও ১২৫ টাকায়।
এ সময়ে ভোজ্যতেলের পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, গত ১৫ দিন ধরে খাতুনগঞ্জ এলাকার তেলের দাম পড়ছে। এতে অনেক ডিও ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা লোকসানে পড়েছেন। এর মধ্যে অনেকের অবস্থা খারাপ। তিনি বলেন, গতকাল মণপ্রতি সয়াবিনের দর পেয়েছি ছয় হাজার ৪৫০ টাকা এবং পাম পাঁচ হাজার ৫০ টাকা। অর্থাৎ খেলা বাজারের সয়াবিন লিটারপ্রতি ১৫৮ টাকা এবং পাম ১২৩ টাকা ৭৫ পয়সা। তবে বোতলজাত সয়াবিনের বিক্রি অনেক কম।
জানা যায়, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ থেকে ২২ লাখ টন। এর বিপরীতে বছরে আমদানি হয় ৩০ থেকে ৩৩ লাখ টন। এর মধ্যে পাম অয়েল ১৮ টন এবং সয়াবিন ১২ লাখ টন। এসব চাহিদার সিংহভাগ তেল সরবরাহ করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবয়েল, এস আলম গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ভোজ্যতেল আমদানি হয় প্রায় ৩৩ লাখ টন।
ভোজ্যতেল আমদানিকারকরা জানান, গত বছর সয়াবিন তেলের বার্ষিক গড় দাম আগের বছরের তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেড়েছিল। প্রতি মেট্রিক টনের মূল্য ৮৩৮ থেকে এক হাজার ৩৮৫ ডলারে উন্নীত হয়। আর চলতি বছরে মার্চে এক হাজার ৯৬৫ ডলার পর্যন্ত ওঠে। এপ্রিলে তো দুই হাজার ১০০ ডলারের বেশি দাম উঠেছিল। যদিও জুনের শেষদিকে দাম কিছুটা কমতে শুরু করে। চলতি জুলাইয়ে দামের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। এখন এক হাজার ৩২০ থেকে এক হাজার ৩৫০ ডলারে লেনদেন হচ্ছে। তখন দাম বাড়ার সর্বশেষ প্রভাবক হিসেবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বড় ভূমিকা পালন করেছে। আর এখন ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ছানে লকডাউন, ভারতসহ বড় ভোক্তা দেশগুলোর চাহিদা হ্রাস, তেল উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানিকারক দেশগুলোয় মজুত বেড়ে যাওয়ায় বাজারে এমন দরপতন হচ্ছে।
এ বিষয়ে ক্যাব ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি ছিল, তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওই সুবিধা নিয়ে আমদানিকারকরা তেল দেশের বাজারে আনলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বিপরীত ঘটেছে এবং ভোক্তারা তার কোনো সুফল পায়নি।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে, দেশে তার বিপরীতে বাড়ানো হচ্ছে? আবার ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের উল্টো সুর। ভোজ্যতেলের এফওবি দাম কমলেও বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের উচ্চমূল্যসহ নানা কারণে দাম আগের অবস্থানে ফিরছে না বলে তারা দাবি করেন।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক বড় একটি ভোজ্যতেল আমদানিকারক গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, বন্দর দিয়ে এখন যেসব তেল আমদানি হচ্ছে, তার ঋণপত্র বিশ্ববাজারে চড়া দাম থাকার সময় খোলা হয়েছে, যা এখন বাজারের সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু গত কিছু দিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় দরপতনের হচ্ছে। সেসব তেল দেশে আসতে দেড় মাস সময় লাগবে। হয়তো তখন দাম সমন্বয় করে সেল করা হবে।
তিনি আরও বলেন, হয়তো লোকসান দিয়ে তেল বিক্রি করতে হবে। কারণ রেট তো বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব নয়। এখন বাজারে চাহিদা কম। কারণ ঈদ মৌসুম হওয়ায় সবার স্টক আছে। তবে এ রকম দরপতন তেমন হয়নি। এবারে দ্রুত ওঠে এবং দ্রুত পড়েছে।